ক্রিমিয়ার গণভোটের ফলাফল যা অনুমান করা হয়েছিল, তা থেকে ভিন্ন কিছু হয়নি। যারা ভোট দিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই-ই রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার একীভূত হওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ার সতর্কবাণী ও হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে গণভোট হয়েছে। যে নির্বাচনকে কার্যত রাশিয়া ছাড়া আর সব দেশই ‘অবৈধ’ বলে বর্ণনা করেছে, তার ভিত্তিতে ক্রিমিয়া এখন রাশিয়ার অংশে পরিণত হবে। রাশিয়ার পার্লামেন্টে এ বিষয়ে ভোট হবে ২১ মার্চ। যদি তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়, তবে ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ যে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়ার অংশে পরিণত হবে।
ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার অধিকাংশ রুশ ভাষাভাষী। প্রায় ১৩ বছর আগের হিসাবে ৫৮ শতাংশ; এখন সম্ভবত তার চেয়ে বেশি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ইউক্রেনীয়রা এক-চতুর্থাংশ ও তাতাররা ১২ শতাংশ। এই গণভোট তাতাররা বর্জন করেছিল। তারা অংশ নিলে তাদের ভোট কোন দিকে পড়ত, আমার তা সহজেই অনুমান করতে পারি। তাতারদের স্মৃতি থেকে এই ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার নয় যে সোভিয়েত নেতা স্তালিনের নির্দেশেই ১৯৪৪ সালে প্রায় দুই লাখ তাতারকে ক্রিমিয়া থেকে দেশান্তরিত করা হয়েছিল। পরে দেশান্তরিত ব্যক্তিদের এক বড় অংশই অনাহারে ও রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। তাতাররা একে গণহত্যা বলেই মনে করে।
তা ছাড়া ক্রিমিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি যা ছিল, তাতে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে মত প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু এ কথা সবাই জানে, ক্রিমিয়ার গণভোট আসল বিষয় নয়, আসল প্রশ্ন হলো ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী। এটা জানাই ছিল যে পশ্চিমা বিশ্বের হুঁশিয়ারির কারণে এ নির্বাচন বন্ধ হবে না; পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা যে এ বিষয়ে কোনো রকম বিভ্রমের মধ্যে ছিলেন, তা-ও নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের যে দেশগুলো ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা কী করতে পারে, কী ব্যবস্থা নিতে পারে—সেসব প্রশ্ন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন, আপাতদৃষ্টে এবং স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সামনে বিকল্প খুব কম। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি থাকার কারণে রাশিয়ার যে সুবিধা রয়েছে, তাতে সমতা আনতে পারে, এমন কোনো কৌশলগত অস্ত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে নেই, যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই। তা ছাড়া অনেকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ইউরোপ তার দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ কেনে রাশিয়া থেকে, এর প্রায় অর্ধেক, প্রায় ১৪ শতাংশ আসে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। জার্মানির ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার কোম্পানির বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ায়। এর মানে হলো রাশিয়ার সঙ্গে বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইউরোপের কিছু বাধা রয়েছে। সে কারণে ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের ক্ষেত্রে সেই মতপার্থক্য দেশগুলো দূরে রাখতে পেরেছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে চীন রাশিয়ার পক্ষেই অবস্থান নেয়। কিন্তু এ ভোটের সময় চীন ভোটদানে বিরত ছিল। তার পরও ক্রিমিয়ার পরিস্থিতি দেখে বলা যায় যে ইউক্রেন প্রশ্নে এখন রাশিয়া দাবা খেলায় সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলছে; তদুপরি এক চাল এগিয়ে থাকার সুবিধাও লাভ করছে।
এ অবস্থায় দুটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এখন পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষ্য কী? রাশিয়া যে অবস্থান নিয়েছে, তা কি মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদে বহাল রাখা সম্ভব? এখন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের গৃহীত পদক্ষেপ থেকে মনে করা যায় যে পশ্চিমা বিশ্বের আশু ও প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষা করা। রাশিয়া ইউক্রেনে অর্জিত সাফল্যের পর রুশভাষীদের রক্ষার কথা বলে ইউক্রেনের পূর্বাংশে অগ্রসর হয় কি না, সেটাই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছে অন্যান্য দেশ। সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে রাশিয়া উৎসাহী হবে না বলেই মনে হয়, যদিও সে ধরনের ভঙ্গি অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন চাইবেন পশ্চিমাদের চাপের মধ্যে রাখতে। কিন্তু যদি কোনো কারণে ইউক্রেনের অন্য অঞ্চলে রাশিয়া পা বাড়ায়, তবে সব হিসাবই বাতিল হয়ে যাবে।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং ভাবা হচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে অর্থনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করার কৌশলকেই প্রধান উপায় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাদের আশা, এতে রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে এনে একধরনের সমঝোতায় রাজি করানো যাবে। ইউক্রেন-সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এক হিসাবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার স্টক মার্কেট থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা; মার্চের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। রুশ মুদ্রা রুবলের মূল্য কমছে। এখন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হলে ওই এলাকার জন্যও ব্যয় করতে হবে, যা এত দিন ইউক্রেনের দায়িত্ব ছিল। রাশিয়ার মোট জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ নির্ভর করে ইউরোপে রপ্তানির ওপরে, ফলে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তার প্রভাব হবে ব্যাপক।
কিন্তু এসবই হচ্ছে এ মুহূর্তে আশু পদক্ষেপের বিষয়। একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব পারস্পরিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে। কিন্তু ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে ভ্লাদিমির পুতিনের গৃহীত পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যে আলোচনাকে জোরদার করেছে, তা হলো রাশিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছিল, ভ্লাদিমির পুতিন নিজে সুস্পষ্ট করে না বললেও রাশিয়ার অনুসৃত নীতি ও পদক্ষেপের মধ্যে ‘পুতিন ডকট্রিন’ দানা বাঁধছে। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পুতিন এ লক্ষ্য নির্ধারণ করেন যে রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য অভ্যন্তরীণভাবে তাঁর প্রথম কাজ হয়েছে অর্থনীতির ওপরে, বিশেষ করে তেল ও গ্যাসশিল্পের ওপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে দেশের রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ববাদী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যমের ওপরে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে—পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিতে—তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার অবস্থান জোরদারভাবে হাজির করা।
এ ডকট্রিনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত হালনাগাদ করা ‘ফরেন পলিসি কনসেপ্ট’ ডকুমেন্টে। সেখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল যে রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ওপরে, বিশেষ করে আঞ্চলিক ইন্টিগ্রেশনের ওপরে জোর দেবে। এ ইন্টিগ্রেশনের বিষয়কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নীতিনির্ধারকেরা যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব দেননি বলেই অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয় যে এটি আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের একটি চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ফরেন পলিসি জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিও এরন একে ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ বা ফিনল্যান্ডকরণ বলে বর্ণনা করেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ডের ওপর সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ধরনের ব্যবস্থায় রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ও অর্থনীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কিন্তু পররাষ্ট্র বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মস্কো। যে কারণে পররাষ্ট্র বিষয়ে যখনই কোনো সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেছে, তাদের বইতে হয়েছে বড় ধরনের মাশুল। রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ২০০০ সাল থেকেই পুতিনের আরেকটি লক্ষ্য হয়ে ওঠে রাশিয়ার পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা এবং সে লক্ষ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি রপ্তানি করা। এ বিবেচনা থেকেই রাশিয়া তুরস্ক, ইরান, বেলারুশ, বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রির বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
ইউক্রেনের ঘটনা ‘পুতিন ডকট্রিনের’ বিষয়টি এখন সবার কাছেই সুস্পষ্ট করে তুলেছে। এখন ইউক্রেন বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন নীতিনির্ধারকদের বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠছে এ ডকট্রিনের আলোকে রাশিয়ার পরের পদক্ষেপ কী হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে তা মোকাবিলার উপায় কী।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১৭ মার্চ ২০১৪