বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবছরের শুরু থেকে একের পর এক লোমহর্ষক নরহত্যা আমাদের হত বিহবল করে দিচ্ছে। এসব হত্যার পেছনে কারণ খুজতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছি আমরা। ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক কারণে গুম, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম, ধর্ষণের পর হত্যা, শিশু হত্যা, অধিকার আদায়ের আওয়াজ তোলায় হত্যা, নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে হত্যা, সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে হত্যা, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হত্যা, সর্বশেষ মত প্রকাশের কারণে লেখক হত্যা। নিয়ম করে সবই চলছে। এসবের ফাঁকে উন্নয়নের নামে চলছে হরিলুট। কোন কোন প্রকল্পে কেবল অফিস সজ্জার ব্যয় ধরা হচ্ছে বিয়াল্লিশ কোটি টাকা। ফাঁস হওয়া পানামা তথ্যে উঠে এসেছে পঁচিশজন বাংলাদেশীর নাম, যারা দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন। আগামী মাসে বাকী তথ্য প্রকাশ পেলে আরও অনেক নাম নিশ্চয়ই সেখানে দেখতে পাব।
দেশে হত্যা এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আইনের শাসন, সুশাসন এসব কেবল কথার কথা। এরকম পরিস্থতিতে কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। ৪ঠা এপ্রিল বাঁশখালীতে কয়লাভিত্তক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশ এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছয়জন (স্থানীয় সূত্রমতে) নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বাঁশখালীর ঘটনায় দেখা যাচ্ছে- পুলিশ দাবী করছে যে তারা গুলি চালায়নি, এস আলম গ্রুপের লোকজন গুলি চালিয়েছে এবং পুলিশও গুলিতে আহত হয়েছে। যদি পুলিশের এই বক্তব্য সত্য ও সঠিক বলে ধরে নিই তাহলে দেখতে হবে এখানে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ কে? সেটা যদি গ্রামবাসী হয় তাহলে মামলা হওয়া উচিত ছিল সেসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যারা গুলি চালিয়েছে। পুলিশের উচিত ছিল যারা গুলিতে আহত তাদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের কাছ থেকে এর বাইরে অন্য কোন প্রত্যাশা ছিল না বা নেই। আমরা জেনেছি ৪ঠা এপ্রিলের ঘটনায় পুলিশ তিন হাজারেরও অধিক লোকের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা করেছে। এখন দেখা যাক এই তিন হাজার লোক কারা? আমরা পত্রিকায় পড়েছি, আহত গ্রামবাসীকে হাতকড়া পড়িয়ে চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তার মানে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী এসব মামলার আসামী। সেটা কি করে হয়? পুলিশের বক্তব্যের সাথে তাদের কাজের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রিশ/চল্লিশটি মোটর সাইকেলে করে তিন হাজার সন্ত্রাসী আসার সুযোগ নেই। তাহলে পুলিশ পরিস্কার মিথ্যা বলছে। পুলিশের উপস্থিতিতে অন্য একটি পক্ষ সাধারণ গ্রামবাসীর উপর গুলি চালাতে দেখে পুলিশ সেই তৃতীয় পক্ষের উপর গুলি করার কথা ছিল, কিন্তু সেটি না করে পুলিশও গ্রামবাসীর দিকে গুলি ছুড়েছে। কেন? পুলিশ কি সেই তৃতীয় পক্ষের কাউকে গ্রেফতার করেছে বা গ্রেফতার করার চেষ্টা করেছে? পুলিশ অবশ্য বলার চেষ্টা করছে তারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে। কিন্তু কোন আইনে? ১৯৪৩ সনের পুলিশ রেগুলেশনে পরিস্কার বলা আছে পুলিশ “ফাঁকা গুলি” ছুঁড়তে পারবে না। কিন্তু এই অজুহাততো পুলিশ দীর্ঘদিন থেকে দিচ্ছে? তাদের কি তাহলে এসব আইন পড়ানো হচ্ছে না? তারা কি নিজেদের মত করে আইন বানিয়ে নিচ্ছেন?
এবার দ্বিতীয় ব্যাখায় আসা যাক- যদি পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি করে থাকে তাহলে তারা গুলি চালানোর আগে আইনে যেসমস্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা সেসব পালন করেছিল কিনা? ১৮৬১ সনের পুলিশ আইন কিংবা ১৯৪৩ সনের পুলিশ রেগুলেশনে বলা আছে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ব্যবস্থা, তাই বারবার জনসমাবেশকে সতর্ক করতে হবে যে, তারা যদি সরে না যায় তাহলে তাদের উপর গুলি চালানো হবে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জনসমাবেশস্থল এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এখানে পুলিশ কিংবা এস আলম গ্রুপের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলা চালানোর কি কারণ থাকতে পারে? যদি এরকম হত যে স্থানীয়রা এস আলম গ্রুপের প্রকল্প স্থানে হামলা চালিয়েছে তাহলেও অন্তত পুলিশের গুলি চালানোর পক্ষে একটা অজুহাত খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু সেরকম কোন ব্যাপার সেখানে ঘটেনি। এখানে কেউ কেউ “উস্কানি তত্ত্ব” দেয়ার চেষ্টা করছেন, যেরকমটা সব রকমের আন্দোলনের বেলায় বলা হয়ে থাকে। প্রাণের হিসেব কষার সময় যারা “উস্কানি তত্ত্ব” দেন তাদের উদ্দেশ্য আর যাই হোক সৎ নয় এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ভাড়াটে বুদ্ধি বেপারিরা পুরো বিষয়কে গায়েব করে দেয়ার আগেই নাগরিকদের নিজের মত করে হত্যার হিসেব বুঝে নেয়া খুব জরুরি।
এখানে বলা হচ্ছে- একটি পক্ষ যারা এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সমর্থন করে তারাও একই স্থানে জনসমাবেশ ডাকলে পুলিশ সেখানে দুপুর ২টায় ১৪৪ ধারা জারী করে। মিটিং হওয়ার কথা ছিল দুপুর ৩টায় এবং দুপুর ২টায় ১৪৪ ধারা জারীর বিষয়ে সমাবেশে আগতরা কিছু জানতেন না এবং ইতিমধ্যে অধিকাংশ জনগণ সমাবেশ স্থলে হাজির হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে গুলি চালানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নেয়া হয়েছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে যে ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর আদেশ দিলেন তার বিরুদ্ধেও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
পুলিশ গুলি চালানোর পর আইন অনুযায়ী একটি সংক্ষিপ্ত তদন্ত করবে এবং সেটি তৎক্ষণাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। এরপর একটি বিস্তারিত তদন্ত করে সেটি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। পুলিশের এই দুই প্রকারের তদন্ত শেষ হওয়ার পর পুলিশের গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা তা যাচাইয়ের জন্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করবে এবং তিনি তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। বাংলাদেশে এযাবতকালে পুলিশের গুলি চালানোর যতগুলি ঘটনা আছে তার কোনটিতেও এসব বিধি বিধান সঠিকভাবে পালন করা হয়েছে বলে জানা নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহারণও আছে- যখনই পুলিশের তদন্ত কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্ত হয়েছে কিনা প্রশ্ন তোলা হয় তখন পুলিশ খুব সহজে তদন্তের কাগজপত্র বানিয়ে আদালতে হাজির করেন এবং আদালত তখন তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে রায় দিতে বাধ্য হন। বিদ্যমান আইন সাধারণ নাগরিকের রক্ষাকবচ না হয়ে তাদের হত্যাকান্ডে সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এসবকে অনেকে আইনের ফাঁক বলতে আমোদ বোধ করেন কিন্তু এসব মোটেও ফাঁক নয় বরং দুর্বলতা যা দূর করা সম্ভব। পুলিশের কাজের “লক্ষণ রেখা” ঠিক করে দেয়া রকেট সাইন্স নয়।
অন্য একটি বিষয় এখানে ভাবার আছে তা হল- এরকম কোন হত্যাকান্ডের পর সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু কোন পুলিশ? সেই দরিদ্র চাষির ছেলে যে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর কনস্টেবল হয়েছে। তার হাতেই অপর এক চাষি খুন হচ্ছেন! ব্রিটিশরা যে উদ্দেশে এদেশে আইন কানুন, আদালত প্রতিষ্ঠা করেছিল, এই একই উদ্দেশ্য সাধনে তাদের সেইসব আইন দিয়ে এখনো আমাদের শাসন করা হচ্ছে। সেই ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা দিয়ে আমাদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসবের ফাঁকে আড়াল হচ্ছে- রাষ্ট্র। নাগরিকের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব রাস্ট্রের- এটি কেতাবি কথা নয়। রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে না পারলে, জানের হেফাজত করতে না পারলে তার জন্যে কি ব্যবস্থা নেবে তা রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে। সেই ব্যবস্থা হিসেবে অপরাধীর বিচারের প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কার বিচার হচ্ছে? রাষ্ট্রকে আমরা যথেষ্ট প্রশ্ন করছি কিনা? রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে কিনা- সেসব দেখা খুব জরুরি।
বাঁশখালীর ঘটনায় দেখা যাচ্ছে পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় নাগরিকদের কথা অনুযায়ী যদি পুলিশ গুলি চালিয়ে থাকে তাহলে তারা কয়টি গুলি চালিয়েছে আইন অনুযায়ী সেসবের হিসেব তাদের কাছে থাকবে। সেসবের হিসেব নিলে বোঝা যাবে কারা কয়টি গুলি চালিয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন এবং যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন তাদের শরীরে যেসব গুলি পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরণ সম্পর্কেও সঠিক তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব। এসব তথ্য যদি সত্যিকার অর্থে উদ্ঘাটন করতে হয় তাহলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ছাড়া সত্য ঘটনা উদঘাটন যাবে না। এখানে রাষ্ট্রসহ প্রতিটি পক্ষের ভূমিকা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনায় করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রের দায় যেন কোনভাবে আড়াল না হয়।
বাঁশখালীর গন্ডামারা গ্রামে সাধারণ মানুষ গত দুই বছয় ধরে ভুমি জবর দখল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যেসব আপত্তি করছিল সেসব নিস্পত্তির জন্যে রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা তা দেখা দরকার। ইউনিয়ন পর্যায়ে কোন গণশুনানী হয়েছিল কিনা? সেখানে সমাধান না হলে উপজেলা, তারপর জেলা এবং সেখানেও নাহলে সংসদে এনিয়ে কোন আলোচনা হয়েছিল কিনা? নাহলে রাষ্ট্র কিভাবে এসব সমস্যা সমাধান করছে তা বিশ্লেষণ করা দরকার। সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে রাষ্ট্র যদি “বল প্রয়োগকে” একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নেয় তাহলে আমাদেরও বুঝতে হবে কোথায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং কোন প্রশ্নটি এখন তুলতে হবে। রাষ্ট্রের আচরণ যদি গণতান্ত্রিক না হয় তাহলে রাষ্ট্র এরকম হত্যার দায় সব সময় এড়িয়ে যাবে। আড়াল হবে রাষ্ট্রের দায়।