রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি মোড় ফেরানো ঘটনা বলেই চিহ্নিত হবে। বাংলাদেশে সহিংস উগ্রপন্থার ইতিহাসে এ ঘটনা অবশ্যই অভূতপূর্ব। কেননা, এর আগে আমরা জঙ্গিদের জিম্মি নেওয়ার এবং তাদের হত্যা করার ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি। বাংলাদেশে এর আগে এ ধরনের কোনো সন্ত্রাসী হামলায় এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে বিদেশি নাগরিকেরাও রয়েছেন, যা সারা বিশ্বের সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। দুজন জে্যষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা এবং সংগঠিতভাবে এই পরিমাণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ আক্রমণের ঘটনাও ঘটেনি। যদিও এর আগে ২০০৫ সালে আমরা কয়েকটি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটতে দেখেছি, কিন্তু এ হামলার ধরন থেকে স্পষ্ট যে হামলাকারীরা আত্মঘাতী হওয়ার মনোভঙ্গি নিয়েই হামলা চালিয়েছিল। এসব দিক এই হামলার পেছনে যে জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আক্রমণের ধারা ও কৌশলের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
গত তিন বছর বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর চালানো আক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা এর আগে দুটি কৌশল লক্ষ করেছি। এর একটি হচ্ছে আলাদাভাবে ব্যক্তিদের ওপর হামলা ও তাঁদের প্রাণনাশ। এ ধরনের হামলার শিকার হয়ে গত ১৯ মাসে কমপক্ষে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। এসব হত্যার অনেকগুলোর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে স্বঘোষিত আল-কায়েদার বাংলাদেশ শাখা আনসার-আল-ইসলাম ও ইসলামিক স্টেট। এ ধরনের হামলার সূচনায় ব্লগাররাই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, কিন্তু ক্রমেই তা প্রসারিত হয়েছে, দেশি-বিদেশি ব্যক্তিরা আক্রান্ত ও নিহত হয়েছেন। কিছুদিন ধরে লক্ষণীয়ভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, যেমন মন্দিরের সেবায়েত বা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ব্যক্তিকে হামলার এই কৌশলের ক্ষেত্রে প্রথম পরিবর্তন লক্ষ করা যায় যখন দেশের শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়। ২০১৫ সালের অক্টোবরে শিয়া তাজিয়া মিছিলে প্রথমবারের মতো হামলার মধ্য দিয়ে কেবল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুই নয়, কৌশলের পরিবর্তনও দৃশ্যমান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিয়া মসজিদে হামলার ঘটনাও ঘটে। এসব হামলার ঘটনা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভাজনের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার ফল। তার অর্থ হচ্ছে শুক্রবারের এ হামলার আগে পর্যন্ত আমরা দুই ধরনের কৌশল দেখতে পেয়েছি। কিন্তু সর্বশেষ এ ঘটনা প্রমাণ করেছে যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
এই নতুন মাত্রাগুলোর সঙ্গে দৃশ্যত আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কৌশলের মিল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি দিক হচ্ছে প্রচারের দিক। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রচারের বিষয়ে, বিশেষত আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখে। এর কারণ একাধিক। দেখা গেছে, বড় ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণের চেষ্টা করে যে তাদের শক্তি রয়েছে এবং এতে করে তারা নতুন রিক্রুটদের সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। ফলে জঙ্গিবাদ–বিষয়ক আলোচনায় এই কৌশলগত মিলের দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে। এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে এ কারণেও যে, এতে করে বোঝা যায় আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো হয় তাদের সাংগঠনিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কিংবা বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই উপস্থিত ছিল, সেগুলো আদর্শিক ও কৌশলের দিক থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
অনেকেই এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর উপস্থিতি-বিষয়ক সরকারের অস্বীকৃতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেবেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না আইএসের পক্ষ থেকে যেকোনো দাবি করার অর্থ এই নয় যে আমাদের সেই দাবিকেই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করতে হবে। এটা মনে করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে আইএস এসব ঘটনা ঘটার পরে তার কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যেকোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব। ফলে এই দাবিকে গুরুত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখাও বাস্তবসম্মত। কিন্তু গুলশানে হামলার বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে তার খবরাদি প্রকাশিত হয়েছে, যখন অন্য মাধ্যমগুলো খবর দিতে অপারগ হয়েছে।
আরও লক্ষণীয় যে আইএসের বার্তা সংস্থা বলে দাবিদার ‘আমাক’ ঘটনা অব্যাহত থাকার সময়েই জিম্মি পরিস্থিতির বিষয়ে খবর ও ছবি প্রকাশ করেছে। এই সূত্র নিহত হওয়ার যে সংখ্যা বলেছিল নিরাপত্তা অভিযান শেষে তার সত্যতা মিলেছে। ফলে এ বিষয়ে অন্য সময়ে সন্দেহ করতে পারলেও এবার তার সুযোগ ছিল না, এটা স্বীকার করতেই হবে।
আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী উপস্থিত আছে কি না, এ–বিষয়ক আলোচনায় এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি চোখে পড়ে, যা থেকে মনে হয় যেন আন্তর্জাতিক জঙ্গি বলে পরিচিতদের শারীরিকভাবেই হামলাস্থলে উপস্থিত হতে হবে। আর অধিকাংশের কল্পনায় তারা সম্ভবত বিদেশি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়াও যে জঙ্গিদের মধ্যে আদর্শিক এবং কৌশলগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেটা বিস্মৃত হওয়া মোটেই সমীচীন নয়। ইদানীং বিভিন্ন দেশে আইএসের নামে যেসব জঙ্গি আক্রমণ ঘটেছে, তার সবই যে আইএসের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও সাংগঠনিকভাবে তৈরি করা পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে, তা নয়; বরং আমরা দেখতে পাই যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করার ঘটনা ঘটেছে এবং সে ক্ষেত্রে সাংগঠনিক যোগাযোগের প্রয়োজন হয়নি। বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কারণে এটা এখন সহজতর হয়েছে।
ফলে বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের অনুসরণ করার বিষয়টিকে কোনো অবস্থাতেই অকিঞ্চিৎকর বলে ভাবা ঠিক হবে না; বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের সূচনা থেকেই আঞ্চলিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এই বিবেচনায় গুলশানের সুরক্ষিত এলাকায়, যেখানে বিদেশিদের উপস্থিতি নিশ্চিত, সেখানে চালানো এই হামলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এটির একটি কারণ যে আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করা, সেটা সহজেই বোধগম্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে জঙ্গিরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সেটা প্রথমত কোথায় হামলা চালানো হয়েছে ও হামলার ধরনের কারণে। কিন্তু এখন নিহতের সংখ্যা ও বিদেশি নাগরিকেরা নিহত হওয়ার কারণে তা অব্যাহত থাকবে, আগামী দিনগুলোতে এ বিষয়টি যে অপসৃত হবে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এ হামলা পরিচালনাকারীদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটির দিকে আমাদের তাকানো দরকার একাধিক কারণে। প্রথমত, এই তরুণদের সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের মতোই, যাঁরা অন্যান্য দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছেন। এঁরা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্য এবং তাঁদের কেউই ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হননি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব তরুণ-তরুণী সিরিয়ায় যুদ্ধে গিয়ে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের প্রচলিত অর্থে সমাজের বাইরের বলে মনে হবে না। তাঁদের অধিকাংশ সমাজের বঞ্চিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন—এমন দাবিও করা যাবে না, যদিও তাঁদের মধ্যে সমাজের প্রতি ক্ষোভ ও বঞ্চনার বোধ থাকে। তাঁরা ভাবেন যে এ ব্যবস্থায় তাঁরা ও তাঁদের সম্প্রদায় বঞ্চিত হচ্ছে বা তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, যদিও এটা ঠিক, এঁরা ইসলাম ধর্মের কোনো না কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন, কিন্তু এঁদের মধ্যে ধর্মের আচার-আচরণ পালনের লক্ষণ খুব কম। এঁদের প্রণোদনা হচ্ছে রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিই তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে বলেই দেখা যায়। কিন্তু তাঁরা বৈশ্বিক রাজনীতিকে কখনোই তাঁদের কাছের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন বলে মনে হয় না। দেশের রাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতি তাঁদের কাছে কোনো না কোনো সূত্রে গ্রথিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে কি না, আমরা নিশ্চিত করে তা বলতে পারব না, তবে তার ইঙ্গিত দৃশ্যমান। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই ‘জঙ্গি’ বলে যে স্টেরিওটাইপ তৈরি করা হয়েছে, এই আক্রমণকারীরা তাতে পড়ে না।
এ ঘটনার পরে এই প্রশ্ন করা খুব জরুরি যে দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন উপস্থিত আছে কি না, সেই বিতর্কে প্রবৃত্ত থাকার কারণে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান হুমকি ও শক্তি সঞ্চয়কে কার্যত অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং হচ্ছে কি না? একই সঙ্গে জঙ্গি মোকাবিলায় এযাবৎ যে কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে, তার কার্যকারিতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। জঙ্গি মোকাবিলার কৌশলের প্রশ্নে মনে রাখা দরকার যে সামরিক দিক তার একটিমাত্র উপাদান। সরকার, নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকেরা যদি এখনো এসব বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনা করতে অনীহ বা অপারগ হন, তবে তা কেবল দুঃখজনক নয়, আত্মঘাতীও হবে বলে আমার আশঙ্কা। গুলশানের ঘটনার পরে জঙ্গিদের ক্রমবর্ধমান শক্তি, কৌশলের পরিবর্তন ও তাদের সঙ্গে আদর্শিক, সাংগঠনিক বা কৌশলগতভাবে দেশের বাইরের সংগঠনগুলোর যোগাযোগের বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে না নেওয়াটা কার্যত এই অভূতপূর্ব, ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা না নেওয়ারই শামিল হবে। সরকার যদি সেই পথে হাঁটেও দেশের মানুষ বা আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ বিষয়ে যাঁরা নজর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় ভিন্নভাবেই দেখবেন।
৪ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত