Share the post "জঙ্গীবাদ ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিতর্ক : জঙ্গীবাদের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ"
আমার এই লেখাটির তিনটি অংশ, প্রথম অংশে আমি জঙ্গীবাদের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করবো। এই পর্বে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের প্রাসঙ্গিক ড্রাইভার বা চালক নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে। দ্বিতীয় অংশে জঙ্গীবাদ ও এর সাথে প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটি নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার উপর আলোকপাত করবো। তৃতীয় ও শেষ অংশে জঙ্গীবাদের সাম্প্রতিক আলোচনা কিভাবে ভুল দিকে পরিচালিত হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলবো।
জঙ্গীবাদের চালক বিশ্লেষণ
অনেকেই জঙ্গীবাদের বিস্তার কিভাবে হয়, আর কিভাবে তা প্রতিরোধ করতে হয় সেটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই মনে হয় । জঙ্গীবাদের চালকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিকভাবে এক্সক্লুশন বা বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা। বাংলাদেশের মূলধারার বাইরে সামাজিকভাবে মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়ারা সামাজিকভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন। তবে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরেও সুষ্ঠু চিন্তাধারার প্রকাশ উৎসাহিত না হলে কেউ বিচ্ছিন্নতাবোধ করতে পারে। এই ধরণের বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বৈষম্য থেকে জন্ম নিতে পারে তীব্র হতাশা। আমরা সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই অর্থের অভাব নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব নয়, বরং আইডেন্টিটির ক্রাইসিস, এবং হতাশা থেকে জন্ম হয়েছে বর্তমান সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণার উৎসের দিকে আমাদের তাকাতে হবে। এই ঘৃণার উৎস কি পরিবার, বা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান?
জঙ্গীবাদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মতে রাজনৈতিক পরিসর কমে যাওয়া, সরকারের কঠোর অত্যাচার ও নিপীড়ন, বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড ইত্যাদি জঙ্গীবাদের চালক হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিসর বলে অবশিষ্ট কোন কিছু রয়েছে কিনা সেটা নিয়ে তর্ক করার মত পরিসরও নেই। দিনের পর দিন দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি ও রাজনীতির নিম্নগামীতা জঙ্গীবাদকে আর প্ররোচিত করতে পারে। এছাড়াও কেউ যদি মনে করে নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির মুখে রয়েছে, বা নিজেকে বৈশ্বিক রাজনীতির ভিক্টিম বলে মনে করে, তবে সে ধারণা তাকে জঙ্গীবাদের পথে ধাবিত করতে পারে। আর এক্ষেত্রে উগ্রবাদী লেখক আর প্রচারকদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
এসব সামাজিক ও রাজনৈতিক চালকের পাশাপাশি আমাদের মনোজগতের দিকেও তাকানো উচিত। যেসব তরুণ জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তারা কি খুব ধার্মিক? ধর্মের চাইতে কোন কিছু পাবার তাড়না তাদের বেশি অনুপ্রাণিত করে। ভায়োলেন্সের প্রতি যে তীব্র আগ্রহ এই সমাজ তৈরি করেছে, পশ্চিমা সংস্কৃতি যাকে আরো বাড়িয়েছে, তার কিছুটা হলেও প্রভাব কি আমরা এসব তরুণের আচরণে দেখতে পাচ্ছি? ধর্মের প্রতি টানের চাইতে “হিরোইজম” ও “এ্যাডভেঞ্চার” এর প্রতি আগ্রহই কি এর জন্য বেশী দায়ী নয়? আইএস বা আলেকায়েদার মত জঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে মনোজগতে জঙ্গীরা দুই ধরণের সন্তুষ্টি পায়। প্রথমত:, তারা যে (তাদের মতে) “অনিশ্চিত, অষ্পষ্ট, ভঙুর ও দুর্নীতিবাজ তোষণকারী সমাজে” বাস করছে তাকে আঘাত হেনে তার বিপরীতে এক ধরণের (মিথ্যা) “নিশ্চয়তা” পায়। এই মিথ্যা “নিশ্চয়তাবোধ” তাদেরকে এক ধরণের স্বস্তি দেয়, কি করতে হবে, কি করা উচিত তার একটি পথ দেখিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, জঙ্গী সংগঠনগুলো এসব তরুণদের নিজেদের “গুরুত্বপূর্ণ” ভাবতে শেখায়। যা তাদের একটি নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরিতে সাহায্য করে।
গুলশান ট্যাজেডির পর অনেকেই পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গীবাদের বিস্তৃতির জন্য দায়ী বলে বক্তব্য দিয়েছেন। আমার মতে উপরে উল্লেখিত চালকগুলোকে ঠিকমত গুরুত্ব না দিয়ে ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পরিবারকে দোষারোপ করলে তা আমাদের ভুল পথে নিয়ে যাবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণকে পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে যদি জঙ্গীবাদের অন্যান্য চালকগুলো একটি সমাজে দাপটে বিচরণ করে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা পরিবারকে দোষারোপের আগে সমাজের কোন অংশ থেকে এসব চালক তৈরি হচ্ছে তা দেখা জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারের নজরদারি জরুরী, কিন্তু তার চাইতে বেশি জরুরী জঙ্গীবাদের অনুকূল পরিবেশের জন্ম হতে না দেয়া। একজন তরুণকে তার আশার জায়গা দেখানোর জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করা প্রয়োজন, গণতন্ত্র ও প্রচলিত ব্যবস্থা যে জঙ্গীবাদের প্রদর্শিত পথের চাইতে বেশি অনুকরণীয় সেটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এ যুদ্ধ আইডিয়ার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ স্বপ্ন দেখানোর যুদ্ধ, এ যুদ্ধ শক্তিশালী আইডেন্টিটি তৈরির যুদ্ধ।
জঙ্গীবাদ ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিতর্ক
সম্প্রতি জঙ্গীবাদের সাথে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সম্পর্ক নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, বিশেষ করে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিকে জঙ্গীবাদের আখড়া বলে অভিহিত করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করেছি তারা নর্থ-সাউথকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করিনি। ছাত্রজীবনে আমরা অনেকেই এটিকে উন্নত কোচিং সেন্টার, মুরগির ফার্ম, আর শিক্ষার্থীদের ব্রয়লার মুরগি হিসেবে বলে এক ধরণের বিমলানন্দ পেয়েছি। আমার মনে হয় এখনো অনেকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে এভাবেই দেখেন। কিন্তু কিছু কিছু প্রথম সারির প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরিস্থিতি পাল্টেছে, বেশ ভালই পড়াশুনা হয়, নিয়মিত ক্লাশ হয়। আমেরিকান সিস্টেম অনুসরণ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার তীব্র চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শিক্ষকদের একাংশের বেশ ভাল ডিগ্রি রয়েছে, গবেষণার আগ্রহও চোখে পড়ার মত। আমি বলছি না এসব বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিস্তৃত জ্ঞানের ভান্ডার, কিন্তু বেশ কিছু বিভাগে উন্নতির চেষ্টা রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি জোরেশোরেই এই উন্নতি হচ্ছে। ব্যবসা ও বাজার ভিত্তিক সাবজেক্টের বাইরে সামাজিক বিজ্ঞান ও আর্টসের মত অলাভজনক বিভাগও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করছে। আমার মনে হয় কিছুদিনের মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা অনেকেই মনে করি নর্থসাউথের মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ধনীর দুলালরা পড়েন। আমি নিজেও অনেকটা এরকম ধারণা পোষণ করতাম। এ ধারণা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মধ্যবিত্তের সন্তানরাও পড়েন। বেশ কিছু শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপে জানতে পারি কিভাবে বাবা-মা তাদের কষ্টের টাকায় ছেলেমেয়েদের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। এসব বাবা-মা এই অর্থকে এক ধরণের বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন। জমানো টাকায় জমি কেনা, সম্পত্তি বাড়ানো বা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের চাইতে একটু ঝুঁকি নিয়ে নিজের ভালবাসার সন্তানের পেছনেই খরচ করছেন অনেকেই। আমরা যারা ঢালাওভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করি, ধনীর বখে যাওয়া সন্তানদের আস্তানা বলে মনে করি তারা এ বিষয়টি অনেক সময় বুঝতে পারিনা, বা বুঝলেও হয়তো আমাদের তর্ক প্রমাণের খাতিরে এড়িয়ে যাই।
গুলশানে জঙ্গি হামলার পর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপের নতুন জোয়ার উঠেছে। দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, রাজনৈতিক নেতা একযোগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করে নানা মন্তব্য করেছেন। গুলশানে জঙ্গী হামলায় যারা জড়িত ছিল বলে জানা গিয়েছে তার কয়েকজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। এর আগে জঙ্গী হামলার সাথে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর এক ধরণের যোগাযোগ আছে বলে অনেকে অভিযোগ তুলতেন। অনেক বিশেষজ্ঞ এসব মাদ্রাসা বন্ধেরও দাবি জানান। মাদ্রাসা থেকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত এই ট্র্যানজিশন নি:সন্দেহে গবেষণার জন্য একটি নতুন ধাপ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেটা গ্রামের মাদ্রাসাই হোক আর আপনার ঝাঁ চকচকে শহরের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিই হোক, সরাসরি কি জঙ্গী উৎপাদনের জন্য দায়ী? কয়েকজন শিক্ষার্থীর কৃতকর্মের দায়ভার কি দেশজুড়ে ছড়িয়ে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিতে পারে? উদাহরণ হিসেবে নর্থ-সাউথের কথাই ধরি। এখানে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশুনা করেন। এদের সবার দায়িত্ব কি একটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিতে পারে? এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি দুর্গের মত, কয়েকশ সিকিউরিটি গার্ড, আইডি চেক, সিসিটিভি ক্যামেরা আর সার্বক্ষণিক সারভেইলেন্স থাকার কারণে নিজেকে মাঝেমাঝে বন্দী মনে হতে পারে। এসবের পরেও কি কয়েকজন সাবেক ছাত্রের এ ধরণের অধ:পতন ঠেকানো গিয়েছে? আরো নিরাপত্তা বাড়িয়ে কি সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব?
শুধূ নর্থসাউথ কেন, যেকোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেকোন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বা কর্মকর্তার কেউ যদি জঙ্গিদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কোন ধরণের প্রমাণ থাকে, তবে তিনি যতই গুরুত্বপূর্ন ও ক্ষমতাশালী হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে দ্বিধাহীন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু ঢালাওভাবে ২২ হাজার শিক্ষার্থীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গির আস্তানা বলার আগে আমাদের চিন্তা করা উচিত সেই অভিভাবকের কথা যিনি তিলে তিলে টাকা জমিয়ে তার সন্তানকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ভবিষ্যতে একটি ভালো চাকুরির আশায়, সেই শিক্ষকের কথা যিনি সারাজীবন বৃত্তির টাকায় পড়ে বিদেশে মেধার স্বাক্ষর রেখেও বুকে স্বপ্ন নিয়ে নিজের দেশে ফিরে এসেছেন, আর অসংখ্য নামহীন মানুষের কথা যাদের জীবিকা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত।
ভুল পথে জঙ্গীবাদের আলোচনা
আমি মনে করি জঙ্গীবাদের আলোচনা ভুল পথে ঘুরপাক খাচ্ছে। হালের প্রাইভেট ইউভার্সিটি বা আগের কওমি মাদ্রাসাকে ঢালাও দোষারোপ না করে জঙ্গীবাদের ধারক ও চালক কে চেনার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করার সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সমাজ যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, রাজনীতির পরিসর যদি কমে যায়, বৈষম্য ও বঞ্চনা যদি বেড়ে যায়, বৈশ্বিক রাজনীতিতে হতাশার উপাদান যদি বাড়তেই থাকে তবে কোন পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তা এককভাবে মোকাবেলা করতে পারবেনা। এ জন্য দরকার রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সমন্বিত উদ্যোগ। সমাজ ও রাজনীতিকে স্থিতিশীল করে, নিজস্ব পরিচয় নির্মাণে সহযোগীতা করে ও হতাশার উৎসকে নির্মূল করে জঙ্গীবাদ দমন করা সম্ভব। জঙ্গীবাদের উৎসমূলে আঘাত না হেনে বাইরে থেকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ নির্মাণ করলে নিরাপত্তা নয়, বরং অনিশ্চয়তাপূর্ণ ভবিষ্যতেরই জন্ম হবে। তাই আসুন জঙ্গীবাদের চালকগুলোকে চিনি, এবং তাদের নির্মূল করার সর্বাত্মক চেষ্টা করি।