যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই চলছে হিসাব-নিকাশ—কে জিতবেন? কীভাবে জিতবেন? কে জিতবেন, সে বিষয়ে আগাম আভাসের জন্য প্রায় প্রতিদিনই চালানো হচ্ছে অসংখ্য জরিপ, যার অধিকাংশ চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো এবং রাজনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রধান দুই দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কাজে পিছিয়ে নেই। এসব জরিপের বাইরে দলগুলো নিজেদের কৌশল নির্ধারণ এবং কোন গণমাধ্যমে কতটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে, সেটা নির্ধারণের জন্য জরিপ চালায়, এই জরিপগুলো প্রকাশ করা হয় না।
জনমত জরিপ হয় দুই ধরনের: জাতীয় পর্যায়ের জরিপ, যার উদ্দেশ্য সারা দেশে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থা কী, সেটা বোঝা। আর অঙ্গরাজ্যগুলোতে জরিপ, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই অঙ্গরাজ্যে কে জিতবেন সেটা বুঝতে চেষ্টা করা। অঙ্গরাজ্যগুলোতে জরিপের ফলাফল থেকে ‘কীভাবে জিতবেন’ অন্ততপক্ষে ‘কীভাবে জিততে পারেন’ এই প্রশ্নের উত্তরের ইঙ্গিত মেলে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া এমন যে তাতে দেশের একাংশের যথেষ্ট সমর্থন, এমনকি সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থনও বিজয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। জিততে হলে একজন প্রার্থীকে সংগ্রহ করতে হয় ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোট, যার মোট সংখ্যা ৫৩৮টি। দুটি অঙ্গরাজ্য ছাড়া বাকি অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রার্থীরা সেই ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে বিজয়ী হন, আর তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অর্থাৎ ২৭০টি পেলেই একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের এই ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে জনসংখ্যার অনুপাতে; ফলে অঙ্গরাজ্যগুলোর গুরুত্বের তারতম্য রয়েছে। বেশি জনসংখ্যার অঙ্গরাজ্যে বেশি ইলেকটোরাল ভোট, তাদের গুরুত্ব বেশি। ফলে প্রার্থীদের বিজয়ের কৌশলের প্রধান দিক হচ্ছে বড় অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা, কিন্তু কেবল বড় অঙ্গরাজ্যে জিতলেই চলবে না, দরকার ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটও।
যেকোনো প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এই ২৭০টি ভোট প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি করেন। মার্কিন গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় একে বলা হয় ‘হোয়াইট হাউসে যাওয়ার বিভিন্ন পথ’। ভালো কৌশলের সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে অনেকগুলো পথ তৈরি করা। ধরে নেওয়া হয় নির্ধারিত যেকোনো পথেই বাধা তৈরি হতে পারে, অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো করতে পারে, ভোটারদের মন বদল হতে পারে, কিংবা ভোটাররা যেকোনো কারণেই হোক ভোট দিতে না-ও আসতে পারেন। ফলে প্রার্থীরা হিসাব করেন কতভাবে হোয়াইট হাউসে পৌঁছানো যায়।
হোয়াইট হাউসে যাওয়ার এই পথ কার্যত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মতোই। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভোট কার্যত একেকটি ধাপের ইটের মতো কাজ করে; অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যকে একত্রে একেকটি ধাপ বলে আমরা কল্পনা করতে পারি। এভাবেই প্রার্থী হোয়াইট হাউসের পথে এগোতে থাকেন।
সেই বিবেচনা থেকেই নির্বাচনের এক মাসের সামান্য কম সময় আগে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার সম্ভাব্য পথরেখা দেখানো হয়েছে ওপরের ছবিতে। আমি একে চার ধাপে ভাগ করেছি। বাঁ দিক থেকে যাত্রা শুরু করছেন হিলারি ক্লিনটন আর ডান দিক থেকে শুরু করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অঙ্গরাজ্যগুলোতে সাজানো হয়েছে ওই অঙ্গরাজ্যে প্রার্থীর সমর্থনের মাত্রার ওপরে ভিত্তি করে। বাঁ দিকে হিলারি ক্লিনটনের সমর্থনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথম যে অঙ্গরাজ্য—ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া (ডিসি) সেখানে তাঁর সমর্থন বেশি, সেখান থেকে তাঁর যাত্রা শুরু। অন্যদিকে ডান দিকে প্রথম ধাপের সবচেয়ে শেষের রাজ্য হচ্ছে নেব্রাস্কার একটি আসন, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই সমর্থনের মাত্রা নিরূপণের জন্য আমি ব্যবহার করেছি ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আগের তিন সপ্তাহের বিভিন্ন জনমত জরিপ, অতীতে ওই অঙ্গরাজ্যের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল এবং নির্বাচনের জরিপভিত্তিক বিশ্লেষণের ওয়েবসাইট ‘ফাইভথার্টিএইট’-এর প্রজেকশন। তিন সপ্তাহের একাধিক জরিপ যেমন বিবেচনা করা হয়েছে, তেমনি বিবেচনায় রাখা হয়েছে যে, এসব জরিপে ওঠানামা ছিল। অনেক অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক জনমত জরিপ পাওয়া যায়নি, কেননা সেখানে একজন প্রার্থী এতটাই এগিয়ে আছেন এবং ঐতিহাসিকভাবে ওই অঙ্গরাজ্যটি কোনো দলের এত শক্ত ঘাঁটি যে সেখানে নিয়মিতভাবে জরিপ করা হয় না। উদাহরণ হচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসি, ২০১২ সালে বারাক ওবামা ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় ৯১ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, মিট রামনি পেয়েছিলেন ৭ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে ওয়াইওমিংয়ে সর্বশেষ জনমত জরিপ চালানো হয় সেপ্টেম্বরের গোড়াতে, যাতে ট্রাম্পের সমর্থন হচ্ছে ৫৪ শতাংশ, হিলারি ক্লিনটনের ১৯ শতাংশ। ২০১২ সালে ওবামা পেয়েছিলেন ২৭ শতাংশ ভোট। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমি দেখাতে চেয়েছি যে মোট ২৭০টি ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে কে এগিয়ে আছেন। (নেব্রাস্কা এবং মেইন যেহেতু যথাক্রমে তাঁদের পাঁচটি এবং চারটি ভোট বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে, সেহেতু ছবিতে এই দুই অঙ্গরাজ্যের নাম একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে)।
ওপরের ছবিতে হিলারি ক্লিনটনের প্রতি জোর সমর্থন রয়েছে এমন সব অঙ্গরাজ্যকে গাঢ় নীল রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁর সমর্থনের মাত্রা কমতে থাকলে তুলনামূলকভাবে হালকা নীল রং দেওয়া হয়েছে। বিপরীতক্রমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের জন্য গাঢ় লাল এবং হালকা লাল ব্যবহৃত হয়েছে। আইওয়া ও ওহাইও অঙ্গরাজ্যকে ভিন্ন রং দেওয়া হয়েছে। কেননা, এই দুই রাজ্যে কারও সমর্থনই এখনো এতটা সুস্পষ্টভাবে স্থায়ী প্যাটার্ন তৈরি হয়নি যে, তা কারও তালিকায় যুক্ত করা যায়।
হিলারির সমর্থনের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাঁর প্রতি জোর সমর্থন রয়েছে সেসব অঙ্গরাজ্যে আছে ১৮৮টি ইলেকটোরাল ভোট, তাঁর প্রতি উল্লেখযোগ্য সমর্থন আছে সেখানে আছে ৬৪টি ইলেকটোরাল ভোট, অর্থাৎ সব মিলে ২৫২ ভোট। তাঁর পক্ষে ২৭০ ভোট সংগ্রহ করার সম্ভাবনা ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তা-ই নয়, এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে নেভাডা, ফ্লোরিডা ও নর্থ ক্যারোলাইনার মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাজ্যে না জিতেও হিলারির পক্ষে নির্বাচনে জেতা সম্ভব। তবে অনুমান করা হচ্ছে এর মধ্যে তিনি দুটিতে জিততে পারবেন। তার অর্থ হচ্ছে যদি এখন যেসব রাজ্যে তিনি এগিয়ে আছেন, সে রকম প্রায় চারটি অঙ্গরাজ্যে হারলেও তাঁর বিজয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে না—হোয়াইট হাউসে যাওয়ার জন্য হিলারি একাধিক পথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্পের জন্য এখনকার শক্তিশালী এবং দুর্বল সমর্থনের অঙ্গরাজ্যগুলো তো ধরে রাখতেই হবে—যার সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু তাঁর দরকার হবে আইওয়া, ওহাইও, নর্থ ক্যারোলাইনা, ফ্লোরিডা, নেভাডা ও কলোরাডো। অন্যথায় তাঁকে হিলারির দুর্বল সমর্থন আছে এমন একাধিক অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হতে হবে। এখন পর্যন্ত সেই সম্ভাবনা খুবই কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ভৌগোলিক দিক—ট্রাম্পের সমর্থনের ভিত্তি হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, সেগুলো তাঁর দরকার এবং সেগুলো তাঁর সঙ্গে আছে; অন্যদিকে হিলারি তাঁর বিজয়ের জন্য একটা ফায়ারওয়াল তৈরি করেছেন, সেটা দেশের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চল উইসকনসিন, মিনেসোটা ও মিশিগান; এই ফায়ারওয়ালে চিড় ধরলে হিলারির জন্য বিপদের আশঙ্কা।
এই হিসাব বিষয়ে দুটি বিষয় মনে রাখা দরকার—প্রথমত, নারীদের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অশোভন ও অবমাননাকর মন্তব্যসংবলিত ২০০৫ সালের ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর যে পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে, তাঁর নিজের দলের নেতাদের সমর্থন তিনি যেভাবে হারাচ্ছেন, দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সিনেট ও প্রতিনিধিসভার প্রার্থীরা যেভাবে তাঁর কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন, তাতে করে ট্রাম্প আরও খারাপ ফল করতে পারেন। ইতিমধ্যে প্রকাশিত একাধিক জনমত জরিপে সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই পূর্বাভাস কোনো চূড়ান্ত বিষয় নয়, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ঘটলে তার প্রতিফলন নির্বাচনে পড়বে।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১৫ অক্টোবর ২০১৬; গ্রাফিক্স প্রথম আলো’র সৌজন্যে