December 3, 2024
অনুবাদ: জি এইচ হাবীব

প্রথম অধ্যায়

‘অনুবাদকবৃন্দ এবং বর্ণমালা আবিষ্কার’

মোটামুটি চল্লিশ লক্ষ বছর হবে মানুষ এই ধরণীর বুকে বসবাস করছে, মারা যাচ্ছে, কিন্তু তাদের লেখালেখির বয়স ছয় হাজার বছরের বেশি হবে না। লিখনের আদিমতম রূপ সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপির জন্ম বেশ সাদামাটাভাবেই মেসোপটেমিয়ায়; কৃষিজ ও বাণিজ্যিক হিসাবরক্ষণের সুবিধার্থে। শিগগিরই মিসর আর চীনেও সেটির অন্য পদ্ধতি সৃষ্টি হয়। যেখানেই লিখনের অস্তিত্ব ছিল, সেখানেই এটিকে এক ঐশ্বরিক উপহার হিসেবে দেখা হয়েছে, এবং তা একটি এলিট বা ক্ষমতাধর অভিজাত শ্রেণীর বিশেষাধিকারে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিসরীয় পুরাণে জ্ঞান, ভাষা ও জাদুর দেবতা থথ’কে লিখনের উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে, যিনি অন্য দেবতাদের পরামর্শদাতা ও অনুলেখক হিসেবে কাজ করতেন।

‘Hieroglyphics’-এর মানে আসলে ‘পবিত্র উত্কীর্ণলিপি’। লিখনের সঙ্গেই ইতিহাসের জন্ম হলো। সেই সঙ্গে, অনুবাদেরও। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সুমেরীয় এবলাইট শব্দাবলি উত্কীর্ণ ৪ হাজার ৫০০ বছর পুরনো মাটির ফলক আবিষ্কার করেছেন। এই দ্বিভাষিক তালিকাগুলো সুদূরতম ইতিহাসেও অনুবাদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে। লিখন খুব শিগগিরই বাণিজ্যিক চুক্তি, ধর্মীয় শিক্ষা, আইন, এবং সাহিত্যের প্রিয় মাধ্যমে পরিণত হয়। প্রাচীন সভ্যতায় অনুলেখকরা লিখন, শিক্ষাদান এবং অনুবাদে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁদেরকে বেশির ভাগ প্রশাসনিক কাজই করতে হতো, এবং তাঁরাই ধর্মীয় ও লোকায়ত যত বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, লিখনের উদ্ভাবনে তাঁরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাঁদের নাম মুছে গেছে।

এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে— সম্ভবত বিব্লসে (Byblos, অধুনা বৈরুতের উত্তরে) ফিনিশীয়দের হাতে একটি বর্ণমালা আবিষ্কার ছিল আদতেই এক বৈপ্লবিক ঘটনা। বর্ণমালাভিত্তিক অ্যাবস্ট্রাকশন ব্যবহার করলে (মানে, প্রতিটি ধ্বনির জন্য একটি করে অক্ষর বা চিহ্ন বরাদ্দ করলে), লেখার জন্য মোটামুটি গোটা তিরিশেক হরফ জানলেই চলে, শয়ে শয়ে এমনকি হাজারে হাজার চিহ্ন বা জটিল ড্রইং, যেমন— চিত্রলিপি (pictogram), হাইয়ারোগ্লিফিক্স (hieroglyphics) বা ভাবলিপি (idiogram) মনে রাখার দরকার পড়ে না। যেহেতু ফিনিশীয়রা ছিল বণিক ও নাবিক, ভূমধ্যসাগরের তীরে বসবাসরত অন্যান্য জাতির মাঝেও তাদের বর্ণমালা ছড়িয়ে পড়ে। আরামায়িক, হিব্রু, গ্রিক, কপ্টিক আর আরবি, সব বর্ণমালাই ফিনিশীয়টি থেকে এসেছে। নিজেদের ভাষার ধ্বনিগুলোর অত্যন্ত স্পষ্ট ও নিখুঁত প্রতিরূপ সৃষ্টি করার জন্য গ্রিকরাই প্রথমে স্বরবর্ণ ব্যবহার করেছিল, আরামায়িক বর্ণমালায় যেসব চিহ্ন ব্যঞ্জনধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করত, সেগুলো ব্যবহার করে। এর ফলেই সৃষ্টি হয় অ, ঊ, ঙ এবং ণ হরফগুলোর। ‘ও’ হরফটি গ্রিকদের আবিষ্কার, যেমন— মোমের ফলকের ব্যবহারও তাদের আবিষ্কৃত। সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক বর্ণমালার পালা এল লাতিন বর্ণমালা জন্ম দেয়ার, যদিও মধ্যবর্তী ধাপ হিসেবে এট্রুস্কান বর্ণমালা ছিল। বর্ণমালাকে মানবেতিহাসের অপরিহার্য একটি বিষয় বলে গণ্য করা হয়, এবং মনে করা হয় যে, এই বর্ণমালার আবির্ভাব জ্ঞানের গণতন্ত্রায়নের সূচনা করেছে।

ভাষাতাত্ত্বিকরা শনাক্ত করেছেন যে, আজ সারা দুনিয়াজুড়ে প্রায় সাত হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলে, যদিও সেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকশ ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য আছে। সনাতনী কিছু লিখন পদ্ধতিকে হটিয়ে দিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের পছন্দের লাতিন বর্ণমালা ধীরে ধীরে ঠাঁই করে নিচ্ছে, এবং তাঁরা বিশেষ সেই অঞ্চলের ভাষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করার জন্য সেগুলোয় ডায়াক্রিটিক্যাল চিহ্ন যোগ করে দিচ্ছেন। লিখন উদ্ভাবনের দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসে অনুবাদকদের সুনির্দিষ্ট অবদান নির্ণয় করা সবসময় খুব সহজ নয়, তার পরও তাঁদের কয়েকজন আমাদের পরিচিত। কয়েকটি জাতিকে স্মৃতি উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছেন এমন চারজন অনুবাদকের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরা হবে এ পরিচ্ছেদে: উলফিলা (Ulfila, গথিক বর্ণমালার উদ্ভাবক, চতুর্থ শতক, বুলগেরিয়া); মেসরপ মাশতত্স (Mesrop Mashtots, আর্মেনীয়, আলবেনীয় ও জর্জীয় বর্ণমালার উদ্ভাবক, পঞ্চম শতক, আর্মেনিয়া); সিরিল (Cyril), গ্লাগলিতীয় (Glagolitic) বর্ণমালার উদ্ভাবক (নবম শতক, মোরাভিয়া); এবং জেমস ইভান্স, যিনি ক্রি (Cree) ভাষার জন্য সিলেবলভিত্তিক লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন (ঊনবিংশ শতক, কানাডা)।

উলফিলা

উলফিলা (ক্ষুদে নেকড়ে) ৩১১ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্ভবত রুমানিয়ার কোথাও জন্মগ্রহণ করেন। রোমক যেসব খ্রিস্টান বন্দিকে তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে গথরা কাপাডোশিয়া থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, উলফিলা মায়ের দিক থেকে তাদের বংশধর। দ্বিতীয় শতক থেকে ভিস্তুলা নদীর অববাহিকা আর কৃষ্ণ সাগরের উত্তর তীরে যেসব জার্মান জাতি বাস করে আসছে গথরা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় দলে রূপ নেয়। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে ভিসিগথ বা পশ্চিমা গথেরা তাদের দলনেতা প্রথম এলারিকের নেতৃত্বে রোমে লুটতরাজ চালানোর আগ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের ওপর তারা মাঝে মধ্যেই হামলা করত।

এই ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বা পটভূমি থেকেই বোঝা যায়, পেগানদের মধ্যে বাস করেও উলফিলা কী করে খ্রিস্টীয় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের লেক্টর বা রিডার ছিলেন। তাঁর দায়িত্বের অংশ হিসেবেই বাইবেল পাঠ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে অনুবাদক হিসেবে তাঁর কাজের এটি ছিল একটি প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি। ৩৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সে-সময়ের খ্রিস্টধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং যিশুখ্রিস্ট স্বর্গীয় কোনো সত্তা নন— এই ধর্মদ্রোহিতামূলক মতবাদ বা এরিয়ানিজমের (Arianism) প্রবক্তা ইউসেবিয়াসের (Eusebius) হাতে উলফিলা বিশপ পদে অভিষিক্ত হন।

উলফিলার ওপর খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব ছিল, যে-সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল দরিদ্র খ্রিস্টান যত বন্দি যারা তখন ভিসিগথদের মধ্যে বাস করত। সাত বছর ধরে তিনি সেখানে বিশপ পদে ছিলেন, এবং এরিয়ানিজম প্রচারে কাজ করে বেড়িয়েছেন। ৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে উলফিলা এবং তাঁর অনুসারীরা দানিউব নদী পেরিয়ে দক্ষিণে রোমক একটি রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই দলবদ্ধ দেশত্যাগ বা এক্সোডাসের কারণে তাঁর নাম হয় ‘আমাদের সময়ের মুসা’। আধুনিক বুলগেরিয়ার ত্রনোভো শহরটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে নিকোপলিস নামক স্থানে তিনি থিতু হন এবং তেত্রিশ বছর সেখানেই বাস করেন।

ধর্মপ্রচারের কাজে উলফিলার জন্য বাইবেলের অনুবাদ অপরিহার্য হয়ে পড়ে, এবং শিগগিরই তিনি উপলব্ধি করেন যে, সেজন্য একটি বর্ণমালা উদ্ভাবন করা খুবই জরুরি। এ পর্যন্ত গথিক পুরোপুরি একটি কথ্য ভাষা ছিল। গথিক ধ্বনির লিখিত রূপ দিতে উলফিলা গ্রিক আর লাতিন থেকে নেয়া হরফ ব্যবহার করলেন। প্রাচীন জার্মান এবং স্ক্যান্ডিনেভীয় বর্ণমালা থেকে ধার নেয়া কিছু রুনিক হরফও যোগ করেন তিনি। সাতাশটি হরফ-সংবলিত উলফিলার বর্ণমালাকে যেন আমরা গথিক নামে পরিচিত জার্মান লিপির সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি, যা কিনা স্রেফ লাতিন বর্ণমালার গ্রাফিক প্রতিলিপি।

একদল সহযোগীর সাহায্য নিয়ে উলফিলা বাইবেল অনুবাদের কাজে নেমে পড়লেন। চল্লিশ বছর বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এই দানবীয় কাজটি সম্পন্ন করেন। গথদের আগ্রাসী চরিত্রের কথা মাথায় রেখে তিনি ‘রাজাবলি’ (Book of Kings) অংশটি অনুবাদে বিরত থাকেন, পাছে সেখানে লড়াই-সংগ্রামের অগুনতি যে বর্ণনা রয়েছে, তা যুদ্ধের প্রতি তাদের প্রবল অনুরাগ উসকে দেয়। উলফিলার মনে হয়েছিল তাঁর সহকর্মীরা অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয়, এবং জোরজবরদস্তি ও লুটতরাজপ্রবণ।

অনুবাদ করার জন্য উলফিলা গ্রিক টেক্সট নিয়ে কাজ শুরু করলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেটির শব্দক্রম আর বাক্যগঠন (syntax) অনুসরণ করে। প্রায়ই তাঁকে বাধ্য হয়ে নতুন নতুন শব্দ বা শব্দবন্ধ আবিষ্কার করতে হতো। ‘এই অনুবাদের মাধ্যমে […] গথিক সাহিত্যের স্থপতি হিসেবে উলফিলা বিশিষ্টতা অর্জন করেন, যা আমাদের জার্মান ভাষাগুলোর পনের শতকব্যাপী বিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করে। ভাষাটির যেসব উপাদান উলফিলা তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছেন, তা সব জার্মান বাগধারায় সঞ্চারিত হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ ‘fastan’ ক্রিয়াপদটির কথা বলা যেতে পারে। গথিক ভাষায় শব্দটির মানে ‘টিকে থাকা’, ‘হার না মানা’ (to hold out); উলফিলা এটির সংগে ‘উপবাস করা’-এর (to fast) ধর্মীয় অর্থ যোগ করলেন। শব্দটি আজো আধুনিক ইংরেজি, ওলন্দাজ (vastan) ও জার্মান ভাষায় (fasten) এভাবেই ব্যবহূত হয়।’ (ভ্যান হুফ ১৯৯০ঃ৩৯, Henri Van Hoof, ‘Traduction biblique et genèse linguistique’)। রোমক সম্রাট থিওডসিয়াস, যিনি খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে এরিয়ানিজম দমনে সচেষ্ট হন। যদিও Council of Nicaeaতে, সেই ৩২৫ সালেই এরিয়ানিজমকে একটি হেরেসি বা ধর্মদ্রোহিতা বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু এত দিন সম্রাট মতবাদটিকে সহ্য করেই আসছিলেন। কিন্তু এবার তিনি সেটির অনুসারীদেরকে খ্রিস্টসমাজ থেকে বহিষ্কার করলেন। উলফিলাকে তাঁর বিশ্বাসের সমর্থনে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরার জন্য কনস্টান্টিনোপলে তলব করা হলো, যদিও কাউন্সিলের সামনে কথা বলার অনুমতি তাঁকে কখনই দেয়া হয়নি। তিনি যখন মারা গেলেন ৩৮২ বা ৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর বয়স তখন সত্তরের বেশি।

প্রচুর লিখেছেন বিশপ উলফিলা, বিশেষ করে এরিয়ানিজম বিষয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময়ের খুব কম লেখাই আমাদের হাতে এসে পৌঁছতে পেরেছে। গথিক ভাষার বিরল কিছু নমুনার মধ্যে রয়েছে উলফিলাকৃত বাইবেল অনুবাদের কিছু কিছু ভগ্নাংশ— ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত Codex Argenteus— যা লাল পার্চমেন্টে সোনা আর রুপোর কালি দিয়ে লেখা। এই মূল্যবান দলিলটি সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রাখা আছে। এমন হূষ্টপুষ্ট অবস্থায় উপনীত হওয়া একটি জার্মান ভাষার সবচেয়ে পুরনো দলিল বা প্রমাণ উলফিলার বাইবেল। এটি এমন একটি কাজ, যা খ্রিস্টধর্মে নবদীক্ষিতদের ধর্মীয় উদ্দীপনা আরো জোরালো করতে, গথদের মধ্যে এরিয়ানিজম প্রসারে আর তাদের জাতিগত পরিচয় সংরক্ষণে সাহায্য করেছে।

[ দৈনিক বণিকবার্তা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৬]

দ্বিতীয় পর্ব 

Leave a Reply