অনুবাদকবৃন্দ এবং বর্ণমালা উদ্ভাবন
‘স্লাভ-কুলে সিরিল ও মেথোডিয়াস’
(শেষার্ধ)
একটা লিখনরীতি হাতে পেয়ে এবং মেথোডিয়াস ও জনাকয়েক শিষ্যের সাহায্যের সুবাদে সিরিল এবার পবিত্র বাইবেল, স্তোত্রাবলি বা প্রার্থনাসংগীত (the Psalms) ও গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনার (liturgy) প্রচুর বইপত্র প্রাচীন স্লাভোনিক ভাষায় অনুবাদের কাজে হাত দেয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছলেন। নতুন গ্লাগোলিটিক বর্ণমালা ব্যবহার করে প্রথম যে-কথাগুলো অনূদিত হলো তা হচ্ছে : “In the beginning was the Word, and the Word was with God, and the Word was God.” (আদিতে বাক্য ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বরের কাছে ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বর ছিলেন)। একটি নতুন লিখনরীতির সূচনা এবং স্লাভোনিক সাহিত্যের জন্মের জন্য সন্তজনের সুসমাচারের প্রারম্ভিক চরণটির চাইতে উপযুক্ত আর কিছইু হতে পারত না। মেসিডোনীয় স্লাভদের উপভাষাটি এভাবেই অন্যান্য লিখিত ভাষার অবস্থান ও মর্যাদা লাভ করল। সিরিলের অনুবাদের গুণগতমান যাচাই করে রজার বার্নার্ড লিখেছেন: ‘আশ্চর্যজনক যথার্থতার সঙ্গে তিনি স্লাভদের প্রাচীন ভাষা নথিবদ্ধ করেছেন; একটি অভ্রান্ত প্রণালিবিদ্যা (methodology) ভিত্তিক তার অনুবাদ মধ্যযুগের অন্যান্য অনুবাদের চাইতে স্পষ্টতই বেশ উঁচুমাপের ছিল।’
বর্ণমালা ও অনুবাদগুলো সঙ্গে নিয়ে ৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিল ও মেথোডিয়াস অবশেষে দূর মোরাভিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তারা সেখানে পৌঁছানোর পর রাস্টিস্লাভ তাদের নানা সম্মানে ভূষিত করলেন। তাকে লেখা একটি পত্রে সম্রাট তৃতীয় মাইকেল লিখলেন: “অনুগ্রহ করে উপহারটি গ্রহণ করুন, যা স্বর্ণ বা রৌপ্যালঙ্কার বা ধনসম্পদের চাইতে দামি।” স্পষ্টতই সম্রাট মিশনটি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার এবং মধ্যযুগীয় স্লাভিক সভ্যতার মূল অবলম্বন সেই বর্ণমালাটির কথা বোঝাচ্ছিলেন। গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনা-সংক্রান্ত অনুবাদ চলতে থাকল, কনস্টান্টিনোপলে যার শুরু হয়েছিল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সিরিল আরো বেশি করে স্লাভোনিক ভাষার প্রচলন করতে থাকেন এবং খুব শিগগিরই পুরো মাস্-ই (mass) সে ভাষায় অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। সিরিল এক ‘বর্বর’ ভাষায় ঈশ্বরের বন্দনা গাওয়ার সাহস করেছিলেন এবং সে সময় সেটা অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ ছিল। অবশ্য তিনি কোনো হঠকারী ব্যক্তি ছিলেন না এবং রোমের গির্জার প্রস্তাবিত আচারই অনুসরণ করেছিলেন।
কিন্তু এ পূর্ব সাবধানতা সত্ত্বেও গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনা-সংক্রান্ত নতুন চর্চাটি রোমক যাজকদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হলো এবং সঅলযবার্গের আর্চবিশপের সঙ্গে একটি বিতর্কের সূত্রপাত করল, যিনি সনাতন প্রথা এবং গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনা-সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ব্যাপারে প্রবল উত্সাহী ছিলেন। ভেনিসে, ৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে, গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনায় স্লাভোনিক ভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গে ভর্ত্সিত হওয়ার পরে দুই মিশনারি-অনুবাদক, খুব সম্ভবত পোপ প্রথম নিকোলাসের অনুরোধে, রোমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে, ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে, পোপ দ্বিতীয় আড্রিয়ান পূর্বজনের স্থলাভিষিক্ত হন। গালমন্দ করার বদলে পোপ তাদের খাঁটি বীর হিসেবে স্বাগত জানালেন এবং উষ্ণ অভ্যর্থনাটির কারণ ছিল অংশত এই যে, দুই ভাই সন্ত ক্লেমেন্টের সংরক্ষিত পুত দেহাবশেষ তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সে সময়ে ওই রাজ্যের বৈধ কর্তৃত্ব নিয়ে যখন কনস্টান্টিনোপলের সঙ্গে রোমের দ্বৈরথ চলছে, তখন স্লাভদের ওপর তাদের প্রভাবের কারণেও তারা মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনায় স্লাভোনিক ভাষা ব্যবহারকে পোপ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেন এবং কোনো কোনো বর্ণনামতে, তাদের এমনকি বিশপ পদে উন্নীত করলেন।
দুই বছর পর ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে সিরিল রোমে মৃত্যুবরণ করেন। তার ভাই মেথোডিয়াস ফিরে এসে তার কাজ, অর্থাত্ স্লাভদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা এবং অনুবাদ চালিয়ে গেলেন, যদিও প্রথমেই গ্রেট মোরাভিয়াতে নয়, যেখানে রাস্টিস্লাভকে বন্দি করা হয়েছিল। স্বয়ং মেথোডিয়াসকেও বন্দি করা হয়েছিল। পোপ তার পক্ষে ছিলেন এবং পরে মেথোডিয়াসকে ছেড়ে দেয়া হলেও গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনায় স্লাভোনিক ভাষার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তিনিও যখন মারা যান, তখন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আচার-অনুষ্ঠান লাতিন, গ্রিক ও স্লাভোনিক এ তিন ভাষায় পরিচালিত হয়। দুই অনুবাদককেই তাদের মৃত্যুর অল্প কিছুদিনের মধ্যে সন্তের মর্যাদা দেয়া হয়। তারা ‘স্লাভদের অ্যাপোসল বা সুসমাচার প্রচারক’ নামে পরিচিত। রোমক ক্যাথলিক চার্চ আর অর্থোডক্স চার্চ, উভয়ের কাছেই তারা এখনো শ্রদ্ধার পাত্র এবং বেশকিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশে তাদের বিভিন্নভাবে স্মরণ করা হয়।
সিরিল কিন্তু সিরিলিক (Cyrillic) বর্ণমালা উদ্ভাবন করেননি, সেটা গ্লাগোলিটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তৈরি করা হয়েছে। মেথোডিয়াসের মৃত্যুর পর দুই ভাইয়ের শিষ্যদের গ্রেট মোরাভিয়া থেকে নির্বাসিত করা হয় এবং তারা ‘প্রথম বালগেরীয় সাম্র্রাজ্য’তে পালিয়ে যান। সেখানে তারা সিরিলিক বর্ণমালা তৈরি করেন। গ্লাগোলিটিকের চাইতে সরলতর ‘সিরিলিক’ নামের তেতাল্লিশ অক্ষরের বর্ণমালাটি তৈরির কৃতিত্ব সাধারণত ওহরিডের সন্ত ক্লেমেন্টকে (আনুমানিক ৮৪০-৯১৬ খ্রি.) দেয়া হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, হরফের আকৃতির দিক থেকে সিরিলিক গ্রিকের বেশি কাছাকাছি। এটা মহান পিটারের (জন্ম ১৬৭২ খ্রি.—মৃত্যু ১৭২৫ খ্রি.) তত্ত্বাবধানে ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে সরলীকৃত করা হয় এবং দাপ্তরিক রুশ বর্ণমালার মর্যাদা লাভ করে। সিরিলিক বর্ণমালা ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আবার পরিমার্জিত হয় এবং বেশকিছু বর্ণ হারায়।
মোরাভিয়াতে সিরিল এবং মেথোডিয়াসের মিশনে অংশ নেয়ার পর ক্লেমেন্ট বালগেরীয়ার প্রথম স্লাভিক বিশপ হন, আর সেখানে তিনটে মঠ ও একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন এবং গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনার বাইজান্টীয় পদ্ধতি প্রাচীন বালগেরীয়তে অনুবাদ করেন।
ক্যাথলিক স্লাভরা অর্থোডক্স স্লাভদের চাইতেও বেশি দিন ধরে গ্লাগোলিটিক বর্ণমালা ব্যবহার করে যায়, কিন্তু ত্রয়োদশ শতক থেকে অর্থোডক্স স্লাভরা সেটার বদলে সিরিলিক বর্ণমালা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। রুশী, বাইলোরুশী, মেসিডোনীয়, ইউক্রেনীয়, বালগেরীয় এবং সার্বীয় বর্ণমালাগুলো প্রাচীন সিরিলিক থেকেই এসেছে। দৃশ্যত গ্লাগোলিটিক বর্ণমালা এখনো টিকে রয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে, ডালমেশিয়ার কিছু কিছু ক্যাথলিক যাজকপল্লীতে (parish) তা এখনো ব্যবহূত হয়। স্লাভিক জগতের ইতিহাসে এ বর্ণমালাটির উদ্ভাবন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং সিরিলকে অমর করে রেখেছে। এ সুসমাচার প্রচারক-অনুবাদক এবং তার ভাইয়ের সুবাদে প্রাচীন স্লাভোনিক একটি সাহিত্যিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। এ ভাষাতাত্ত্বিক দলের সদস্যরা ধীরে ধীরে ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসন অর্জন করেন এবং তাদের সাংস্কৃতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যান এবং তার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
(ক্রমশ)
পর্ব ৩ পড়ুন এখানেঃ‘স্লাভ-কুলে সিরিল ও মেথোডিয়াস’ (প্রথমাংশ)
পর্ব ২ পড়ুন এখানেঃ মেসরপ মাশতত্স ও আর্মেনীয় সংস্কৃতির বিকাশ
পর্ব ১ পড়ুন এখানেঃ ‘অনুবাদকবৃন্দ এবং বর্ণমালা আবিষ্কার’