ডিসেম্বর 5, 2025
bank_492485

This post has already been read 13 times!

এবার দেখা যাক সাম্প্রতিক সুবিধাগুলো আদৌ খেলাপি ঋণ কমাতে পারবে কি না অথবা ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরত আনতে পারবে কি না? সরকারি অর্থের বেশি হারে জোগানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কী শর্তে তা করা হবে, তার কোনো প্রবিধানের কথা বলা হয়নি। যে ব্যাংকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নড়বড়ে, সেখানে কড়া রেগুলেশনবিহীন সরকারি অর্থের জোগান দিলে তারল্য বাড়বে, তার সঙ্গে বাড়বে খেলাপি ঋণ বাড়ার ঝুঁকি। যেমন ফারমার্স ব্যাংকে গচ্ছিত সরকারের জলবায়ু তহবিলের টাকা এখনো তারা ফেরত দেয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়
সুদের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌল সূচক পর্যালোচনাও জরুরি। মোটা দাগে সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিস্তৃতি বেড়েছে। দেখা যাবে, ১৯৯১ সালের পর থেকে জিডিপি যেমন বাড়ছিল, একই হারে জিডিপিতে ব্যক্তি খাতের অংশও বাড়ছিল। জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২০১১-১২ সালে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ ২০১২-১৩ সাল থেকে জিডিপিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অংশ হ্রাস পেয়েছে বা স্থবির হয়ে পড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সুদের হার বাড়ায় বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বাবদ খরচ বেড়ে গেছে। এটা দেশের বিনিয়োগের ওপরে বৈরী প্রতিক্রিয়া ফেলবে। দেশে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের ওপরও বিপরীত প্রভাব পড়বে।

বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সাধারণ ব্যাংককে প্রদত্ত সুদের হার মুদ্রানীতির বিষয়। কোনো বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি পরিবর্তন করতেই পারে। কিন্তু পর্ষদে নয়, হোটেলে বসে চাপের মুখে, নির্দেশিত হয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে হয়েছে, কিছু কিছু ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদ্ধতিতে কাজ করবে, তা তার আইনে ও বিধিতে সুস্পষ্ট করা আছে। যে পদ্ধতিতে সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

জবাবদিহির অভাব ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা
একদিকে জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে অন্যদিকে ব্যাংক ব্যবসা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংকে দেয়া অভিনব সুযোগ। সাধারণত সকল ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ শতাংশ ও খেলাপী ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান আছে। ব্যাংকটির ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির যে ঘাটতি আছে তা ২০১৭ সালের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারকে দেওয়া কর সমন্বয়েও ছাড় পেয়েছে। এর ফলে কৃত্রিম উপায়ে ব্যাংকটিকে লাভজনক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। জনগণ জানে, কয়েকদিন আগেও করের টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটানো হয়েছে। অর্থ্যাৎ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তরা লুটপাট করবে, করের টাকা দিয়ে মূলধন ঘাটতি মেটানো হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কৃত্রিম উপায়ে ব্যাংককে তথাকথিত লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৈধতা দেবে! পত্রিকার প্রতিবেদন ও হিসাব নিরীক্ষকদের মতে, ব্যাক্তি খাতের ব্যাংকের ব্যালেন্সশীটেও এরকম জোড়াতালি দিয়ে লাভজনক দেখানো হচ্ছে। কারণ, উদ্যোক্তারা একদিকে ডিভিডেন্ড বোনাস শেয়ার চান আর অন্যদিকে চান শেয়ারবাজারে এগুলো যেন ‘জেড ক্যাটাগরি’তে না চলে যায়। ব্যক্তি খাতের কোন কোন ব্যাংক পুঁজিবাজারে অভিহিত মূল্যেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।

সমাধানের মানসিকতা আছে কি?
ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অর্থ নিয়ে বড় ও ক্ষেত্রবিশেষে মাঝারি গ্রাহকের ফেরত দেওয়ার অনীহা বাংলাদেশ তথা অনেক দেশেই লক্ষণীয়। সে কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, তা জানা থাকলে কী ধরনের দেশোপযোগী পন্থা উদ্ভাবন করা যায়, যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ন্যূনতম রেখে ঋণপ্রবাহ সচল রাখা যায়? বাংলাদেশেও এ ধরনের সৃজনশীল পন্থা আবিষ্কার করা হয়েছে। পোশাকশিল্পের বেলায় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে একদিকে উদ্যোক্তাকে তাঁর কাঁচামাল সরবরাহের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে তাঁর হাতে প্রথমে অর্থ না দিয়ে ব্যাংক রপ্তানির পর প্রাপ্ত অর্থ থেকে দেনা চুকিয়ে উদ্যোক্তার প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ সৃজনশীল পদ্ধতিতে খেলাপি কমানো হচ্ছে এবং ঋণপ্রবাহ বজায় রাখা হচ্ছে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চরিত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু যেসব দেশ উত্তরণে সফলতা দেখিয়েছে, তাদের পুঁজিপতিদের শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা লক্ষণীয়, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বিচারহীনতা ও জবাবদিহির অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আলোচনা হওয়া দরকার কীভাবে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি জোগানো যায়, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ হতে পারে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙা হতে পারে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকব্যবস্থায় সুযোগ, সুবিধা ও সেবা কীভাবে বাড়ানো যায় এবং সুদের হার কীভাবে কমানো যায়। ব্যাংকের প্রোডাক্টে বৈচিত্র্য কীভাবে আনা যায়। এ খাতের প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে কোনো সৃজনশীলতা দেখা যায় না, বরং উল্টো কীভাবে গ্রাহককে আরও বেশি মাত্রায় শোষণ করা যায়-তার বিস্তর অভিযোগ লক্ষণীয়। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাংক হলো একটি ইঞ্জিনের মতো এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে কীভাবে উৎপাদনকে সহায়তা করা যাবে, তাই ব্যাংকব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না। অতীতের ভালো উদাহরণ তথা পোশাকশিল্প খাতে ঋণের প্রবাহ থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়নি। সৃজনশীলতা উপেক্ষিত থেকেছে। লুটপাট প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যর্থতা হলো, ব্যাংককে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরুৎসাহ।

প্রশ্নটা রাজনৈতিক
মোটা দাগে বলতে গেলে, ব্যাংকব্যবস্থায় আজকের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। সন্দেহ নেই, রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কোনো বিকল্প নেই। এটা প্রথম পর্যায়ের কাজ। রেগুলেশনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল চিন্তার প্রয়োজন-তা পোষ্যদের দিয়ে বা মুখস্থবিদ্যায় হবে না; যা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, ব্যাংকের কিন্তু সব গ্রাহক বড় নয়, ক্ষুদ্র গ্রাহকই বেশি এবং ব্যাংক বিভিন্ন উৎপাদন ও সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জনমানুষ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার লাঞ্ছিত হচ্ছে।

‘পিচ্ছিল বাঁশ ও বানরের বাঁশ বেয়ে ওঠা’ বাংলাদেশের মানুষের কাছে পুরোনো এক পাটিগণিত। ততোধিক পুরোনো ‘ডাক্তার আসিবার আগেই রোগী মারা গেল’ বাক্যবন্ধের অনুবাদ। জনমানুষ কি বসে থাকবে, কবে ডাক্তার আসবে এবং ব্যাংকব্যবস্থা নীরোগ হবে?

প্রথম আলো; ০৬ মে ২০১৮, ১২:০৩

This post has already been read 13 times!

মন্তব্য করুন