[সম্প্রতি সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকা আমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। কথকতার পাঠকদের জন্য সেটি এখানে পোষ্ট করলাম।]
প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার নিজের পর্যবেক্ষণ কী?
দীর্ঘ ৪২ বছর পরে বাংলাদেশের মাটিতে এই অপরাধ ট্র্ইাবুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এজন্য আমি সন্তুষ্ট। তবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার জন্য এর পেছনে যে রাজনৈতিক স্পৃহা থাকা দরকার ছিল সেটা অনেকটা ক্ষুন্ন হয়েছে। ২০ বছল আগে যখন গণআদালত বসেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে তখনও যদি এই বিচার ব্যবস্থা শুরু করা হতো এতটা কলুষিত হতো না রাজনীতি এবং এর ফলে বিচার ব্যবস্থাও প্রশ্নের উর্দ্ধে থাকত। তবুও এ বিচার সর্বোপরি ৭১-এ যারা স্বজন হারিয়েছে একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তাদের জন্য একটা স্বস্থিবোধ এনেছে।
প্রশ্ন : বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। এই বিচার প্রসঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে – এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক, মানবাধিকার মহল ও বিরোধী দল থেকে। বিশ্বের যেকোন যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারেই সমালোচনা উঠেছে। এগুলো প্রসিডিউরাল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনাল প্রসিডিউরাল এবং পলিটিক্যল পরিধির মধ্যে একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। বিরোধীদল এ বক্তব্য বলবে রাজনৈতিক কারণে কেননা তাদের জোটের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃবৃন্দ সম্বলিত জামায়াতে ইসলাম পার্টি অন্তর্ভুক্ত। ফলে এ বক্তব্য রাজনৈতিক। অপরদিকে প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও আন্তর্জাতিক মহল এ বিচারের রায় মানে না একথা বলেনি কখনও।
প্রশ্ন : যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার সব অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে এ রায় জানার পর আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিল?
দীর্ঘদিন ধরে বুদ্ধিজীবি হত্যা প্রমাণ করার জন্য আমাকে এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবি সন্তানদের লড়তে হয়েছে। এ রায়ের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবি হত্যা আইনগত স্বীকৃতি পেয়েছে এটা আমাদের ও আমাদের মায়েদের/বাবাদের ও পরিবারের সকলের জন্য একটি অর্জন। তারা যে ৪২ বছর ধরে কষ্ট করেছে , শোকের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছে তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
প্রশ্ন : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এদিকে মহাজোট সরকারের হাতে আর তিন-চার মাস সময় আছে। এই সময়ের ভেতর কি বিচারের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? আগামী নির্বাচনে এই এজেন্ডা কতটুকু বা কী প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়?
আমাদের পক্ষ থেকে এতটুকু দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারব যে যুদ্ধাপরাধীদের রায় অনতিবিলম্বে কার্যকরা করা হোক। একই সময়ে মনে হচ্ছে সরকারের আরও রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে যা রায় কাযকর করার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে। আগামী নির্বাচনে অবশ্যই এ এজেন্ডা পক্ষেও যেতে পারে বিপক্ষেও যেতে পারে। রায় কার্যকর না হলে সরকার দেখাতে চাইবে যে তাদেরকে আবার ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ফিরে আসা দরকার। কিন্তু জনগণ ভাবতে পারে যে সরকার ব্যর্থ হয়েছে তার প্রতিশ্রুতি এবং আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করার বিষয়টা আগামী নির্বাচনে একটি মহলকে প্রভাবিত করবে কিন্তু বৃহত্তর জনগণ এই ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে নাও দেখতে পারে। তারা দেশের অর্থনৈতিক দিকটার দিকেই লক্ষ্য রাখবে বেশি।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাবে ও এর কার্যক্রমে জনগণ বেশ নাজুক ও আতঙ্কজনক অবস্থায় আছে। এদিকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় সংগঠনই হেফাজতে ইসলামকে কোনো না কোনোভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সর্বশেষ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এ দুটি দলকে হেফাজতকে কাছে টানার প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা গেছে। দুদলের এই রাজনৈতিক অবস্থানকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
দুই রাজনৈতিক দলের জন্য এটি একটি আপোষকামী অবস্থা বলে আমি মনে করি। এই দুই মূল ধারার রাজনৈতিক দল হেফাজত ইসলামের আবির্ভাবকে নাজুক বা আতঙ্কজনক অবস্থান বলে মনে করে না বলে আমার বিশ্বাস। তারা কেবল জোট গড়ার ক্ষেত্রে হেফাজতকে চেক এন্ড ব্যলান্সের এর মাপকাঠিতে গঠন করেছে। ধর্ম যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকে এটিই ছিল হেফাজতে ইসলামকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে আসার একটি উদ্দেশ্য। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু মহল উপকৃত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কোন শক্তিশালী দল আসেনি যা উক্ত মহলের এই রাজনীতিকে মোকাবেলা করতে পারে এবং একই সঙ্গে জনসমর্থন দেখাতে পারে। ফলে দেখা যাচ্ছে মূল দুই রাজনৈতিক দলের এ আপোষকামীতা।
প্রশ্ন : হেফাজতের নেতা আল্লামা শফীর সাম্প্রতিক ওয়াজে অশ্লীল, অরুচিকর বক্তব্য দিয়ে সকল মহলে তিনি নিন্দিত হয়েছেন। তিনি নারীদেরও তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে পুরুষদের লালা বহনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে হেফাজতে ইসলাম ও আল্লামা শফীর এ ধরনের বক্তব্যকে কীভাবে দেখছেন?
এসকল বক্তব্য করে উনি নিজেই নিজেকে এবং দলকে কলুষিত করেছেন তবে রাজনৈতিক কোণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবকে উস্কিয়ে দিতে চাইছেন।
প্রশ্ন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে বিএনপি ঈদের পর থেকে কঠোর কর্মসূচির কথা বলছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিরোধের হুমকি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ঈদের পর জাতীয় রাজনীতি সহিংস রূপ নেবে তাতে করে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।
এই বাংলাদেশের জন্য নতুন কোন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক দলের এই অর্থহীন সংঘাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও সবসময় বেড়েছে এবারও বাড়বে। সামগ্রিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটা অনেকটা নির্ধারিত হবে সংঘাতে লিপ্ত দুটি দলের মানসিকতা সাধারণ জনগণের বল প্রয়োগ ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপের উপর। যেখানে এর নিরসন হওয়া উচিত ছিল গণতান্ত্রিক কায়দায় সাংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে সেটা শেষ পর্যন্ত রাস্তায় হবে।
প্রশ্ন : রাজনীতিতে যে আস্থাহীনতার সঙ্কট চলছে এবং যে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে এ দেশের সুশীল সমাজের ভূমিকা রাখার অবকাশ কতটুকু আছে?
সুশীল সমাজকে সাহসী হতে হবে এবং জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে জনগণের কথা প্রতিফলিত করতে হবে।
প্রশ্ন : শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রধান নিয়ামক। সুশীল সমাজের একজন হিসেবে এই দুই নেত্রীকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আসলে ব্যাপারটাকে আমি অন্যভাবে দেখি। আমি মনে করি জাতীয় রাজনীতির প্রধান নিয়মক কোন ব্যক্তি নয়, বরং কিছূ ধারাবাহিকতা। প্রধানতম ধারা হচ্ছে উঠতি শ্রেণী যারা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শক্তি লাভ করেছে কিন্তু এই অর্থনৈতিক বলয়কে রাজনৈতিক প্রভাবে পরিণত করতে আগ্রহী। উল্লেখ্য নবম জাতীয় সংসদে সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্য। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক ধারা হল বংশোদ্ভূত নেতৃত্বের উপর নির্ভর দুটি রাজনৈতিক দল। এই দুইয়ের মধ্যেই হচ্ছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। ফলে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয় নিয়ে কথা না কথা হলো নেতৃত্বের স্বরূপ নিয়ে। বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেকে ভবিষ্যত বাণী করেন যে অদূও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মিডল ইনকাম কান্ট্রি অর্থাৎ মধ্য আয়ভুক্ত দেশ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে একটি উঠতি শ্রেণীও সেটা চায়।
সুতরাং যে রাজনৈতিক দলই এই ভবিষ্যত রাস্তাকে বাস্তবায়ন করতে পারবে, তাদের দিকেই তারা সমর্থন দেবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা যদি সাধারণ মানুষের সুযোগ সুবিধা, সেবা ও নিরাপত্তা না লক্ষ্য করে তাহলে তাদের স্বপ্নবিলাস রানা প্লাজার ভবনের মতই ধ্বসে পড়বে।