This post has already been read 28 times!
খেলাপি ঋণই বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থার সংকটের মূল কারণ। কেন ঋণখেলাপি বাড়ছে এবং সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ পরিস্থিতি উত্তরণে কতটুকু কার্যকর হবে, তা আলোচনা করা দরকার। ব্যাংকব্যবস্থায় কেন খেলাপি ঋণ হয়? এ বিষয়ে কতগুলো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়। এর মধ্যে একটি ব্যাখ্যা কেতাবি অর্থনীতিবিদেরা হাজির করেন। এর মূল বক্তব্য হলো: ব্যাংক ঠিকভাবে গ্রাহক নির্বাচন করতে পারছে না। সে জন্য গ্রাহক যথাযথভাবে কার্যক্ষমতা দেখাতে পারছে না। অতএব ব্যাংকের কৌশলে ভুল আছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে না।
আস্থাহীনতাই স্থবিরতা ও পাচারের কারণ
লক্ষ করা যাচ্ছে, খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে কী কারণে তা ঘটল? এর একটি ব্যাখ্যা যে বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। অন্যদিকে লক্ষ করা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির থাকলেও ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে এবং আমদানি বেড়েছে অনেক হারে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ্বের মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আমদানি ব্যয় গত বছরের একই সময় থেকে ২৬ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে ৩৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে লেনদেনের ভারসাম্যে ৯৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে লেনদেনের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত ছিল ২ হাজার ৪৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর সঙ্গে পুঁজি পাচারের বিষয়টি মেলালে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজতর হয়। তার মানে পরিষ্কারভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন (বিনিয়োগ স্থবির হওয়া) এবং রাজনৈতিক কারণে আস্থাহীনতা। সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব, বিশেষ করে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ক্রমাগত এর পরিমাণ বাড়ছে। তার মানে, অভ্যন্তরীণ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না, কিন্তু বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন প্রকল্পে, বিশেষ করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। শুধু মালয়েশিয়ার নয়, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশে বাংলাদেশিদের পাচারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইস ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব একই কথা বলছে। তার মানে, যখন আস্থাহীনতা থাকে, তখন ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যেমন একধরনের পুঁজির পাচার ঘটে ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ে এবং অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি হয় না আর ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে চায় না। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে ঋণযোগ্য টাকার (তারল্য বা অলস টাকা) বেড়ে যাওয়ার সংকটও দৃশ্যমান হয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে এখানে আস্থাহীনতা অন্যতম কারণ। আস্থাহীনতার কারণে যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা থাকে, সে জন্যই ব্যাংকব্যবস্থার এই সংকট হয়েছে। তখন লুটপাটও বেড়ে যায়, বেড়ে যায় প্রকল্প খরচও। এসবই দৃশ্যমান।
পরিস্থিতি অন্য সময়ে চেয়ে ভিন্ন
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলে থাকেন, দেশে ব্যাংকের আধিক্য আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। ছোট ও দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমানো সমস্যা নিরসনে সহায়ক হবে বলে তাঁরা মত দেন। কিন্তু এ কথা ভুলে যাচ্ছেন, ব্যক্তি খাতে এমন কোনো আহাম্মক নেই, যিনি লাল বাতি জ্বলা ব্যাংক কিনতে যাবেন। সারা পৃথিবীতে ‘বেল আউট’ সরকারকেই করতে হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে ছোট ও দুর্বল ব্যাংককে ‘বেল আউট’ না করে বন্ধ করে দেওয়াই সমীচীন।
তাঁরা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় আনা গেলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিসংখ্যক লোক পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবে না। একসময় তাঁদের কথামতোই বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করে বড় বড় সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। আর্থিক খাতের সংস্কারে বলা হয়েছিল, ব্যক্তি খাতে ব্যাংক বাড়লে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হার কমে যাবে। কিন্তু প্রতিযোগিতায় সুদের হার তো কমছে না; এটি না কমার অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণের বেশি পরিমাণ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলে সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বেশি রাখতে হয়। ব্যাংকের ব্যয় আরও বেড়ে যায়। এ কারণেও সুদের হার কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। এই দুটি ব্যাখ্যার কতক অংশ ঠিক বটে, কিন্তু কোনোভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সহায়ক নয়। তাহলে এমন কী হলো, যে জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অন্য সময় ও অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার?
প্রাতিষ্ঠানিক সংকট ও পরিবারতন্ত্র
প্রাতিষ্ঠানিক সংকটাপন্নতাই সুদের হার বেশি হওয়ার মূল কারণ। ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতেও রাজনৈতিক কায়দায় পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হচ্ছে। ব্যাংক স্থাপনে রাজনৈতিক লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অসুস্থ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে এক পরিবারের দুজনের পরিবর্তে সর্বোচ্চ চারজন সদস্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পারিবারিক কর্তৃত্ব আরও সংহত করা হয়েছে। আরও বেশি সময় পদ ধরে রাখারও সুযোগ পাবেন তাঁরা। টানা দুই মেয়াদে ছয় বছরের বদলে কোনো পরিচালক টানা তিন মেয়াদে নয় বছর পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছে, একই পরিবারের বহু ব্যাংকের মালিকানা। ওই পরিবারগুলো আবার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণের ঋণগ্রহীতা। ঝুঁকির এ ধরনের বড় নজির পৃথিবীতে নেই।
ব্যাংকে তথাকথিত মালিকানা বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক ধারণা প্রচলিত আছে। বিষয়টি খোলাসা করা যাক। নিঃসন্দেহে ব্যাংক একটি কোম্পানি। কিন্তু তা যেকোনো সাধারণ কোম্পানির মতো নয়। সাধারণ কোম্পানিতে পুঁজির জোগান উদ্যোক্তারা ও শেয়ারহোল্ডাররা দিয়ে থাকেন। শুধু কার্যকর পুঁজি (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। এখানে উদ্যোক্তা বা শেয়ারহোল্ডারদের পুঁজির তুলনায় ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে, তার অংশ খুবই কম। আমানতকারীরা অধিকাংশ অর্থের জোগান দেন। তার মানে, ব্যাংকের মালিকানা যার হাতেই থাকুক না কেন, এটি আসলে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। মূলত, সে জন্য রেগুলেশন বা পরিচালনের ধরন ভিন্ন হওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষণীয় যে পরিচালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বিদ্যমান। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারেনি। ব্যাংকব্যবস্থার বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি উপস্থাপন করলেও গণমাধ্যমও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখনো জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি যে ব্যাংক আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। কাজেই আমানতের খেয়ানত করার অধিকার কারও নেই। সে জন্যই ব্যাংকের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যুক্তিসংগত। কিন্তু তা বর্তমানে দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই এখনো ব্যক্তি খাতে ব্যাংকগুলো ছেড়ে দিলে খেলাপি ঋণ ও সুদের হার কমে যাবে—এ ধরনের ভ্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রথম আলো; ০৫ মে ২০১৮, ১১:১১
This post has already been read 28 times!