October 15, 2024

পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে কোভিড-১৯–এর মধ্যেই দেশের ৪৯তম জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়েছে। ইতিমধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকোচন শুরু হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের পর প্রবৃদ্ধির এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম দারিদ্র্য বাড়ছে। কিন্তু এই সংকোচন অর্থনীতির গতানুগতিক কারণ, তথা চাহিদা ও জোগানের হ্রাসের কারণে ঘটছে না; বরং করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সরকার কর্তৃক সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের ফলে অর্থনীতি এ মন্দায় পড়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। করোনার আঘাত সমস্যাগুলো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ প্রশ্নবিদ্ধ। গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদনশীল খাতের অবদান করোনার কারণে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যাবে। বাজেটে ঘোষিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রস্তাবিত ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারও অবাস্তব। কেননা, মহামারি এখনই সমাপ্তির কোনো পূর্বাভাস নেই। তা ছাড়া রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানি আয় করোনার কারণে অনেক কমে যাবে।

জীবন বাঁচিয়ে জীবিকার চাকা সচল করুন
পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে কোভিড-১৯–এর মধ্যেই দেশের ৪৯তম জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়েছে। ইতিমধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকোচন শুরু হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের পর প্রবৃদ্ধির এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম দারিদ্র্য বাড়ছে। কিন্তু এই সংকোচন অর্থনীতির গতানুগতিক কারণ, তথা চাহিদা ও জোগানের হ্রাসের কারণে ঘটছে না; বরং করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সরকার কর্তৃক সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের ফলে অর্থনীতি এ মন্দায় পড়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। করোনার আঘাত সমস্যাগুলো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ প্রশ্নবিদ্ধ। গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদনশীল খাতের অবদান করোনার কারণে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যাবে। বাজেটে ঘোষিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রস্তাবিত ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারও অবাস্তব। কেননা, মহামারি এখনই সমাপ্তির কোনো পূর্বাভাস নেই। তা ছাড়া রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানি আয় করোনার কারণে অনেক কমে যাবে।

সর্বজনীন প্রাথমিক প্রয়োজন—স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন ব্যয় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ স্থিতিশীল রয়ে গেছে, যদিও পরিচালন ব্যয় গত অর্থবছরের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। এবারও জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যদিও এবারই জরুরি ছিল অন্তত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশমতো জিডিপির ৪ শতাংশ বা তার ওপরে বরাদ্দ রাখা। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। নতুন বাস্তবতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ও আধুনিক প্রযুক্তির আওতায় আনতে এই বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়লেও নতুন দারিদ্র্য নিরসনে তা কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ নতুন যোগ হওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, দারিদ্র্য বাড়বে। উন্নয়ন অন্বেষণের হিসাব বলছে, লকডাউনের কারণে আয় কমে যাওয়ায় বা বন্ধ থাকায় ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার চেয়ে কম আয় করবে। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতিতে ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও এবং পদ্ধতিগতভাবে অর্থনীতি পুনরায় সচল করতে পারলে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৪৩ শতাংশে নেমে আসবে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত এলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। করোনাভাইরাস প্রকট অসমতা আরও উন্মোচিত করেছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গিনি সহগ শূন্য দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক ৫০ এবং পা’মা রেশিও ২ দশমিক ৯৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হিসাব বলছে, অন্যদিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১ শতাংশ হ্রাসে বেকারত্বের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে। সুতরাং, জিডিপি হ্রাসের কারণে বেকারত্বের হার ৩ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে। ফলে মানুষের আয় কমে যাবে।

গত ছয় বছর ধরে কৃষিতে ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে আটকে আছে। অর্থ বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছর অনুদানের অনুপাত হ্রাস পাচ্ছে। চাষাবাদে বৈচিত্র্য না থাকায় সমস্যা প্রকট হয়েছে। কৃষি এককেন্দ্রিক শস্য চাষাবাদে আটকে আছে। কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ঘাটতি রয়েছে। এ অর্থবছরে সরকার ভর্তুকিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে, তবে বিশ্বব্যাপী মহামারির মুখে এই বৃদ্ধি স্থিতিশীল খাদ্য সুরক্ষা তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। করোনাকালেও কৃষিতে বাজেটের মাত্রা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এগুলোর কিছুই করা সম্ভব হবে না।

উৎপাদন ও যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় পুরো সরবরাহশৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে পোশাক রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। আনুমানিক সাড়ে ৩ মিলিয়ন বাংলাদেশি পোশাক খাতে কাজ করে এবং প্রায় এক মিলিয়ন শ্রমিককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবার জন্য বরাদ্দ ৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর ৪ হাজার ১০১ কোটি থাকা থেকে কিছু কম। এই বরাদ্দ হ্রাসে মহামারি মোকাবিলা করে উৎপাদনশীল খাতের পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন কঠিন হয়ে যাবে।

অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আরোপিত কঠিন শর্তের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ঋণে সহজ প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না। নারী উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের সব ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে প্রধান বাধা জামানত–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা ও গ্যারান্টি, বাণিজ্য লাইসেন্স ও ঋণপদ্ধতিতে কঠোরতা এবং নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি ব্যাংকারদের মানসিকতা।

সেবা খাতের পুনরুদ্ধারের বিষয়টি বাজেটে উপেক্ষিত থেকে গেছে। জনসেবা, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি সেবা খাতে আগের তুলনায় বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ভর্তুকি ৮০০ কোটি টাকা বেড়েছে। আগের অর্থবছরে প্রদত্ত পরিমাণের দ্বিগুণ। মেগা প্রজেক্টগুলোর সময় বারবার বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যয় আরও বাড়ে। অর্থবছরের প্রথম দিকে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের ধীরগতি এবং শেষ দিকের হঠাৎ উল্লম্ফন প্রশ্ন উদ্রেককারী।

ব্যাংক খাত থেকে অভ্যন্তরীণ অর্থ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ব্যাংকিং অবস্থাকে আরও দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেবে। এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। বর্তমান বাজেটে কর জালিয়াতি ও কর ফাঁকি নিরসনে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কর আদায়ে নতুন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।

এবারের বাজেটে সুযোগ ছিল গতানুগতিক পরিধির বাইরে এসে একটি নতুন ধরনের বাজেট প্রণয়ন, যা করোনা মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি জনরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত তৈরি করত। দুঃখজনকভাবে এবারও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। বাজেটে মানুষের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকে গেছে। অর্থনীতির পুনর্গঠন, পুনরুদ্ধার, পুনরুত্থান নির্ভর করে জীবনের ওপর।

সংক্রমণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। জীবন থাকলে অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা প্রকট। জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো/ থাম্বনেইল সূত্র: NYTIMES

Leave a Reply