April 19, 2024

২৯শে সেপ্টেম্বর, কক্সবাজার জেলার রামু ও উখিয়া এবং চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ায় স্থানীয়রা জ্বালিয়ে দিয়েছিল ১৫টি বৌদ্ধ মন্দির। রামুতে পঞ্চাশটির মত বসতবাড়ীও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একটি সুপরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। আক্রমণকারীদের সংগঠিত করার জন্যে অন্যতম উপাদান ছিল মসজিদের মাইক, ফেসবুক। তারপর থেকে এটা একটা প্যাটার্ন হয়ে গেছে। একইভাবে পাবনার সাঁথিয়ায় এবং কুমিল্লায় পরের বছরগুলোতে হামলা চালানো হয়। রামুর ঘটনায় আগুন দেয়ার জন্যে ড্রামে করে পেট্রোল সরবরাহ করেছিল কেউ, ছিল “গান পাউডার”! গান পাউডারের ছবি আমি নিজে তুলেছি। কোন তদন্তে এর ছিটেফোঁটাও নেই। কেউ প্রশ্ন করেনি স্থানীয়রা “গান পাউডার” পেল কোথা থেকে। এতগুলো পরিবহণ ব্যবহার করা হয়েছে আক্রমণকারীদের পরিবহণের জন্যে। সেসবের কোন হিসেব নেই। আক্রমণের পেছনে যে বাজেট ছিল, সে বাজেটের কারা যোগানদাতা তা আর কোনদিন জানা যাবে বলে মনে হয়না। ওসি নজিবুলের কোন শাস্তি হয়নি, যে বলেছিল- “পুলিশের পোশাক পড়া না থাকলে আমিও মন্দিরে আগুন দিতাম।”

রামু, উখিয়ার ঘটনায় মোট ১৯টি ফৌজদারি মামলা হয়েছিল। ১টি মামলা আপোষ করেছেন বাদী। কার সাথে কে আপোষ করলেন সেটা যদিও পরিস্কার নয়। যেসব ধারায় মামলাগুলো হওয়ার কথা তা আপোষযোগ্য নয় বলেই জানি। কিন্তু আপোষ হয়েছে এবং আদালত তা মেনে নিয়েছেন- এটাই সত্য।

বাকী ১৮টি মামলার পাঁচটিতে পুলিশের তদন্ত সঠিক হয়নি বিবেচনায় আদালত “অধিকতর” তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেসব প্রতিবেদন আসার পরে মোট ১৮টি মামলাতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে।

২টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এসব মামলায় কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। কে কে সাক্ষী হবেন সেটা পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে। পুলিশ তার তদন্তের ভিত্তিতে এসব নাম প্রস্তাব করেন। প্রসিকিউশন সবাইকে ডাকবেন এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে যাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন তাদেরই ডাকবেন। চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকার ফলে যারা সাক্ষ্য দিতে আসছেন তারা কিছুই দেখেননি, কারা জড়িত ছিলেন জানেন না বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

এমনও জানা গেছে যারা জানেন তারাও বিভিন্ন কারণে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সত্য কথা বললেই যে বিচার হবে, অপরাধীর শাস্তি হবে- এই বিশ্বাস রামুর কেউই আর করেন না। স্থানীয় চাপতো আছেই।
১৮টি মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে প্রায় দেড়শ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানেন, সেখানে অনেক প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দেয়া হয়েছে। উদাহারণস্বরূপ- সরকারী ও বিচার বিভাগীয় তদন্তে যার নাম এক নম্বরে এসেছে- সে কোন মামলাতেই অভিযুক্ত নয়। যাদের ছবি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এসেছিল, যেখানে তাদের মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালাতে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগই গঠন করা হয়নি। তারা কিছুদিন পলাতক থেকে আবার এলাকায় ফিরে এসে তাদের মত “স্বাভাবিক” জীবন যাপন করছে।

রামুকান্ডের পর আমি নিজে আবেদনকারী হিসেবে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছিলাম। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে বলা হয়। সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আমি বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলাম। আদালতে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর সেটির কিছু অংশ ফাঁস হয় এবং স্থানীয় যারা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে হুমকি পেতে শুরু করে। এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ফটোকপি করতে গিয়ে একজন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে এই ফাঁস হওয়ার ঘটনায় কারো কোন শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি।
আমার দায়ের করা রিট মামলাটি ২০১৪ সনের মে মাস থেকে চুড়ান্ত শুনানীর জন্যে প্রস্তুত রয়েছে এবং সেটি মাননীয় বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার মহোদয়ের আদালতে শুনানীর জন্যে ধার্য ছিল। কিন্তু কার্যতালিকায় নিচের দিকে থাকার কারণে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও সেই মামলা শুনানী করা যায়নি। পরবর্তীতে উক্ত বিচারপতি মহোদয় আপীল বিভাগে পদোন্নতি পেয়ে চলে গেলে, বর্তমানে কোন আদালতেই মামলাটি শুনানীর জন্যে ধার্য নেই। শুনানীর জন্যে বর্তমানে যে কয়টি আদালত আছে তাদের কার্যতালিকায় মামলার সংখ্যা এতই বেশী যে এটি সহসা শুনানী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। মাননীয় প্রধান বিচারপতি যদি এটিকে অগ্রাধীকার ভিত্তিতে শুনানীর আদেশ প্রদান করেন তাহলেই কেবল এটির শীঘ্র শুনানী সম্ভব।

মামলার শুনানী, বিচার এসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য থাকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর প্রতি বিচারিক সমতা বিধান করা, ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা, তাদের আশ্বস্ত করা যে দেশের আইনের মাধ্যমে তারা নিরাপদ। কিন্তু বর্তমান বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতে সেটি সোনার পাথর বাটি। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে এবং সেটি সারানোর জন্যে সাধারণের তরফ থেকে যে উদ্যেগ নেয়া দরকার ছিল, সরকারের তরফ থেকে যে উদ্যেগ নেয়া দরকার ছিল তা- নেয়া হয়নি। ফলে রামুতে যে সমাজব্যবস্থা দেখতে দেখতে আমরা বড় হয়েছি তা -চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। এটি আর কোনদিন ফিরে আসবে সেই আশা করিনা।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টে একবারে শেষে একটি কথা ছিল- “জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক। সবাই বুদ্ধের বাণী চিন্তা করে যা হয়েছে সব ভুলে যান।” অর্থাৎ, যে তিনজন বিচারক “বিচার বিভাগীয়” তদন্ত করেছেন তাদের নিজেদেরও দেশের “বিচার ব্যবস্থার” উপর কোন বিশ্বাস ছিল না। তাই তারা সব কিছু ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়ে, জগতের সকল প্রাণীর সুখ চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এটাই সত্য। রামুবাসীদের এটাই করা উচিত। আগুন, লুটপাট, ভাঙচুর এসব ফৌজদারি অপরাধ হলেও রামুবাসী যদি এসব ভুলে যায় এবং দেশের আইনও যদি ভুলে যায়, তবে ভুলে যাওয়াই উত্তম।

রামুর মন্দিরে আগুন দেয়ায় ধর্মের ক্ষতি হয়নি মোটেই। বুদ্ধের দর্শনকে যারা ধর্ম মেনে জীবন যাপন করেন তাদের জন্যে সমস্যা হওয়ার কথা না। সমস্যা হয়েছে- সহাবস্থানে, বিশ্বাসে। রাজনীতি এর পেছনে প্রথম থেকেই “হাওয়া” দিয়েছে। ফলে কারো দায়বদ্ধতাই নিশ্চিত করা যায়নি। যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরকম হামলার খবর জেনেও রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন, তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়নি। তার খুঁটির জোর শক্ত থাকায় তিনি আরও উপরে উঠে গেছেন। যে জেলা প্রশাসক হামলার কথা শুনেও বিদায় সম্বর্ধনা বন্ধ করে ঘটনাস্থলে ছুটে যাননি, তাকে কোন কিছুর জন্যেই জাবাবদিহি করতে হয়নি। ততকালীন এস,পি,সহ যেসকল শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত কর্ম সম্পাদনে ব্যর্থ হলেন, তাদের কোন জবাবদিহি করতে হয়নি। এত বড় একটি ঘটনায় একটি টিয়ারগ্যাসও ছোড়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেদিন সত্যিই ভীষণ শান্তিপূর্ণ আচরণ করেছিলেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। তৎকালীন এম,পি, ৫০টি মটর সাইকেলসহ সেখনে কেন গিয়েছিলেন, প্রতিরোধের চেষ্টা না করে ফিরে আসলেন কেন, এসবের উত্তর আর কোনদিন পাওয়া যাবে না। বিচার হয়না, বিচার নেই- এটাই এখন স্বাভাবিক পরিণতি।

এই অপমান নাগরিক হিসেবে আপনার, আপনাদের গায়ে না লাগলে- আমারও লাগে না।

২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ঢাকা

Leave a Reply