April 19, 2024

ছবির সূত্র - বিবিসি

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের ঢাকা সফরকে আমরা কি ইতিবাচক বলে বিবেচনা করব? আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের সরকার যে আগের চেয়ে খানিকটা নমনীয় হয়েছে, এই সফরকে আমরা তার ইঙ্গিত বলেই বিবেচনা করতে উৎসাহী। গোড়াতে বাস্তুচ্যুত ও দেশত্যাগী মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা মিয়ানমার সরকার করেছিল এবং এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে এ জন্য সেনা অভিযান দায়ী নয়। কিন্তু তা যে কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, এই সফরে তার পরোক্ষ স্বীকৃতি মিলেছে। এখন ঢাকা সফর করে মিয়ানমারের সরকার কার্যত মেনে নিল যে এটি এমন এক সমস্যা, যা নেপিডোতে সেনাবাহিনীর অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে সু চির ইংরেজিতে দেওয়া ভাষণে সমাধান হবে না।

মিয়ানমারের নেতারা বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে এবং তাঁদের সমর্থক রাশিয়া, চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক ফোরামে সরবে সমর্থন জোগালেই যে এই বিষয়টি উধাও হয়ে যাবে, তা-ও নয়। এটাও নিশ্চয় ইতিবাচক যে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে নেপিডোতে গিয়ে হাজির হতে হয়নি। কিন্তু এই সফরের এই দৃশ্যমান ইতিবাচক দিকের বাইরে আর যা ঘটেছে, তা একাধারে বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক; দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য তা ইতিবাচক না হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সু চির দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের এই সফরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এই বিষয়ে একমত হয়েছে যে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এই ওয়ার্কিং গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে ‘শরণার্থীদের’ প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ নেবে। আমি ‘শরণার্থী’ শব্দটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছি; কেননা, এযাবৎ কোনো পক্ষই দেশত্যাগীদের ‘শরণার্থী’ বলে বর্ণনা করেনি। কোনো সংবাদেই দুই পক্ষের উদ্ধৃতি দিয়ে এই কথা বলা হয়নি; কেননা, বাংলাদেশের সরকারি ভাষ্যে এরা ‘অনুপ্রবেশকারী’; অন্যদিকে মিয়ানমার এখনো সুস্পষ্ট করে বলেনি যে এরা মিয়ানমারের নাগরিক। অং সান সু চি থেকে শুরু করে সেনা কর্মকর্তারা বলে আসছেন যে যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফেরত নিতে তাঁরা রাজি আছেন।

এই কথার মর্মার্থ বিষয়ে আমরা অবগত, এর বাস্তব সমস্যাও আমরা জানি। কিন্তু ওয়ার্কিং গ্রুপের বিষয়ে আমরা আর কিছুই অবগত নই। এক বৈঠকেই সব সুরাহা হবে এমন মনে করার কারণ নেই। কূটনীতিতে এক বৈঠকে কোনো সমস্যার সমাধানের ইতিহাস নেই। কিন্তু এই বিষয়ে তথ্যাদি দেওয়ার দায়িত্ব কেন এককভাবে বাংলাদেশের ওপরই বর্তাল এবং কেন মিয়ানমারের মন্ত্রী ঢাকায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন না, সেটা নিশ্চয় আমরা জানতে চাইতে পারি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর ছয় মিনিটের প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় মিয়ানমারের মন্ত্রী উপস্থিত থাকলে এই বিষয়ে মিয়ানমারের আন্তরিকতা প্রমাণিত হতো। যেহেতু এটি সরকারিভাবে আয়োজিত ও প্রকাশ্য সফর, সেহেতু একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে দুই পক্ষের প্রতিনিধিই এই নিয়ে ঘোষণা দিলে আস্থা তৈরির সুযোগ তৈরি হতো।

মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনায় আস্থার বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা বাংলাদেশের কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। সাম্প্রতিক কালে মিয়ানমারের আচরণের কথা না হয় বাদই দিলাম, অতীতে রোহিঙ্গাবিষয়ক দুই দফা চুক্তি হয়েছে এবং ১৯৯১-৯২ চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবেই নেতিবাচক আচরণ করেছে। সে কারণে এই দফার পাঁচ লাখ মানুষের আগেও তিন লাখ মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছে। শুধু তা-ই নয়, এখন মিয়ানমার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কালক্ষেপণের চেষ্টা নয়, সেই বিষয়ে সংশয় প্রকাশের কারণ রয়েছে।

তদুপরি উদ্বেগজনক বিষয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এই প্রত্যাবাসনের ভিত্তি হবে ১৯৯২ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। এই চুক্তির কার্যকারিতা যে প্রশ্নবিদ্ধ, তা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায়ই স্পষ্ট। তদুপরি ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া ভাষণে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন যে মিয়ানমার সরকার ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতির কাঠামোর ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। গুতেরেস এ-ও বলেছিলেন, এই চুক্তি থেকে শুরু করা যাতে পারে, কিন্তু ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা যথেষ্ট নয়’।

ফলে ১৯৯২ সালের সেই ঐকমত্যকে কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা হলে তা মিয়ানমারের জন্যই সুবিধাজনক; সে কারণে মঙ্গলবার মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে এটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে তাতে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতার পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। জাতিসংঘের মহাসচিবের এই পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন সেটাকেই ভিত্তি বিবেচনা করেছে এবং কার্যত মিয়ানমারকে একটি সুবিধাজনক অবস্থান থেকে আলোচনার পথ করে দিয়েছে, তা বিস্ময়কর।

এই প্রসঙ্গে এটা সুস্পষ্টভাবেই বলা দরকার যে বাংলাদেশ এখন যে মানবিক সংকট মোকাবিলা করছে, তার আশু সমাধানের জন্য যেকোনো ধরনের চেষ্টায় সাড়া দেওয়াই স্বাভাবিক এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া। আমি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দরজা বন্ধ করার পক্ষে নই। বিশেষ করে যে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া ও ভারত সক্রিয় থাকবে এবং বাংলাদেশ তার বিপরীতে বড় ধরনের কোনো কূটনৈতিক জোট তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের দেওয়া দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের প্রস্তাবে অতিরিক্ত আশাবাদী না হওয়াই বিবেচকের কাজ।

মিয়ানমারের এই দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক চাপ। সেটার যদি অবসান ঘটে, তবে মিয়ানমারের উৎসাহে ঘাটতি পড়বে। আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকে যেসব করণীয় চিহ্নিত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ তো নেয়ইনি, এমনকি তার প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত দেখায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব তিনটি পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন, প্রথমত অবিলম্বে সেনা অভিযান বন্ধ করা; মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা দেওয়ার পথে বাধাগুলো অপসারণ করা এবং সবার নিরাপদ, স্বতঃপ্রণোদিত, সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেখানেও সহিংসতা বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এযাবৎ এই বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণার লক্ষণ নেই। সেই অবস্থায় জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ, কার্যকর ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না।

মিয়ানমারের নেওয়া এই দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপের পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়; প্রথমত, ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের শরণার্থীদের বিষয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এবং আইওএম দাতাদের সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে; মিয়ানমার দেখাতে চাইছে যে সে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত মিয়ানমারের এই পদক্ষেপ সম্ভবত চীনের পরামর্শের ফসল; নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া চীনা প্রতিনিধির ভাষণে সেই ইঙ্গিত ছিল। ফলে ভবিষ্যতে মিয়ানমার চাইবে যে এই প্রশ্নে বাংলাদেশ যেন কার্যত একাকী হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে।

দ্বিপক্ষীয় আলোচনার আরেকটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে যে তাতে রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ এই লাখ লাখ শরণার্থীর দায়িত্ব নিতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের পদক্ষেপে যেন এমন মনে না হয় যে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যে অবস্থানের কথা বলেছিলেন, দেশটি সেখান থেকে ইতিমধ্যেই সরে এসেছে। সেটা বাংলাদেশের দর-কষাকষির ক্ষমতাই হ্রাস করবে।

মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় কেবল যে শরণার্থীবিষয়ক আলোচনা হয়েছে, তা নয়। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা বিষয়েও কথা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব শিগগির এই লক্ষ্যে মিয়ানমারে সফর করবেন বলেও জানানো হয়েছে। শরণার্থী সমস্যার শুরুতেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তে যৌথ নিরাপত্তা অভিযানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এক মাসের বেশি সময় পর এবং পাঁচ লাখের বেশি শরণার্থীর বোঝা কাঁধে নিয়েও বাংলাদেশ কেন তার প্রধানমন্ত্রী সেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সভায় ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযোগ করেছেন, তার সঙ্গে ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’কে আশু জরুরি মনে করছে, তা আমার বোধগম্য নয়। তদুপরি মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে এই বৈঠকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিয়ানমারের উগ্রপন্থী সংগঠন আরসাকে ‘অভিন্ন শত্রু’ বলে বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে। যেকোনো ধরনের উগ্রবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান নিঃসন্দেহে সঠিক ও প্রশংসনীয়। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কোনো বিদ্রোহী বা উগ্রপন্থী বা সন্ত্রাসী সংগঠন বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো ধরনের অবস্থান নেওয়ার আবশ্যকতা আছে মনে করার কারণ নেই এবং তার ফল ইতিবাচক না-ও হতে পারে।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৫ অক্টোবর ২০১৭

Leave a Reply