December 9, 2024

deceased person covered in a sheet with a blank toe tag.

উচ্চ আদালতের দেওয়া ৩৯৬ পৃষ্ঠার একটি রায়ে অন্তর্ভুক্ত নির্দেশনা যখন এক সপ্তাহের মধ্যেই দুই দফা লঙ্ঘিত হয় এবং একজন তরুণের প্রাণহানি ঘটে, অথচ এ নিয়ে আলোচনার কোনো লক্ষণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না, তখন তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। শুধু তা-ই নয়, এর একটি ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে দেশে বিরাজমান একটি আইনের বরখেলাপের আশঙ্কাও সুস্পষ্ট। তারপরও না গণমাধ্যমের আলোচনায়, না মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এ নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখতে পাই; মানবাধিকার কমিশনের কাছে এ খবর পৌঁছেছে এমন লক্ষণ নেই। অথচ এই ঘটনাগুলো ঘটেছে তখন, যখন প্রায় প্রতিদিনই আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষদের কথা শোনা যায়; আইনের স্বাভাবিক গতির কথা না হয় না-ই বললাম।

২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায়ের পূর্ণ ভাষ্যের বিষয় ছিল ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল খারিজ। হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন তার ১৩ বছর আগে, প্রধান বিচারপতিসহ চারজনের বেঞ্চ হাইকোর্টের সেই রায় বহাল রেখে কিছু বিষয়ে সংশোধনী যুক্ত করে রায় দিয়েছিলেন ২৪ মে। আদালতের যেসব নির্দেশনা ছিল, তার মধ্যে ১৬৪ ধারার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে সরকারের হেফাজতে থাকার সময় কারও ওপর নির্যাতন করা যাবে না। নবম সংসদের শেষ দিনগুলোতে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩’ -এও সুস্পষ্টভাবেই সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

অথচ গত ৬ মার্চ পুলিশ নিজেদের পরিচয় না দিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারীকে আটক করে, যা সুস্পষ্টভাবেই ছিল ৫৪ ধারার বিষয়ে ওই রায়ে সংশ্লিষ্ট নির্দেশনার বরখেলাপ (মিজানুর রহমান খান, ‘আদালতের দিকনির্দেশনার লঙ্ঘন ঘটেছে’ প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৮)।

ওই দিন মানববন্ধন থেকে ফেরার পথে ছাত্রদলের একজন নেতা জাকির হোসেনকে রমনা থানার পুলিশ আটক করে। তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শনিবার রিমান্ড শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। সোমবার সকালে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে আনা নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগকে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। কেননা, ঘটনাপরম্পরা অবশ্যই এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে ইঙ্গিত দেয় না।

২০১৩ সালের আইনে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তা আমরা স্মরণ করতে পারি। ‘হেফাজতে মৃত্যু’র ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গ্রেপ্তারের সময় কারও মৃত্যু, কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা না হোক জিজ্ঞাসাবাদের সময় মৃত্যু। আর ‘নির্যাতন’ বলতে বোঝানো হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। জাকির হোসেনের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে এ দুইয়ের প্রাসঙ্গিকতা আছে। এসব বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নীরবতা সে কারণেই আমাকে বিস্মিত করে।

হেফাজতে মৃত্যুর বিষয় নিয়ে আদালতের নির্দেশনার সূচনা সেই ১৯৯৮ সালেই। এর সূচনা হয়েছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কারণেই। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর হাইকোর্ট সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার ও তদন্তের নামে রিমান্ডে এনে আসামিকে শারীরিক নির্যাতন করা থেকে নিবৃত্ত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না মর্মে সরকারের ওপর রুল জারি করেছিলেন। এই আইনগুলো নিয়ে আইনি লড়াইয়ের পটভূমি ও ইতিহাস সম্প্রতি ৫৪ ধারার লঙ্ঘন নিয়ে মিজানুর রহমান খানের আলোচনায়ই আছে, আমি তার পুনরুক্তি করতে চাই না।

মনে রাখা দরকার যে আদালত ১৮৯৮ সালের তৈরি করা এই আইন ছয় মাসের মধ্যে সংশোধনের জন্যই বলেছিলেন; আর সংশোধনের আগ পর্যন্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার জন্য ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক আমলের এই আইন ভারতে বদলে গেছে ১৯৭৩ সালে, কিন্তু বাংলাদেশে তা শুধু বহালই আছে তা নয়, এর ব্যবহার এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কতটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেটা প্রতিবছর হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা গেছেন; ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা গেছেন ৭৮ জন।

নিয়মিতভাবে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে আদালতে মামলা হয় একেবারে নগণ্য। তার দুটি কারণ আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। এর একটি হচ্ছে অভিজ্ঞতা। যাঁরা এ বিষয়ে খবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় জানেন যে ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় র‍্যাবের হেফাজতে নিহত শাহনূর আলমকে কেন্দ্র করে কী ঘটেছিল।

নবীনগরের বগডহর গ্রামের বাসিন্দা শাহনূর আলমকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে র‍্যাব ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়কের বিরুদ্ধে থানায় মামলার দায়ের করার চেষ্টা করেন তাঁর ভাই মেহেদী হাসান ৷ থানা মামলা না নেওয়ায় ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩’ আইনের আওতায় মামলা করতে আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি।

জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নাজমুন নাহার শুনানি শেষে র‍্যাবের ওই অফিসারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত ৷ এই নির্দেশ দেওয়ার পর ওই বিচারককেই ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বদলি করে দেওয়া হয়। এরপর এই মামলার অগ্রগতি সহজেই অনুমেয়। এই অভিজ্ঞতা খুব উৎসাহব্যঞ্জক বলে ভুল করার কারণ নেই।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এই আইন বিষয়ে পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১৫ সালে পুলিশের পক্ষ থেকে ওই আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারা সংশোধনী চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যাতে আইনের ৭টি ধারা বিলুপ্ত করার সুপারিশ আছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও ‘পুলিশ সপ্তাহে’ পুলিশের যেসব দাবিদাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়েছে, তাতে এই আইনের ‘সংশোধনী’র কথাও আছে। ফলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সাহস পান না।

কিন্তু আমার কাছে যে বিষয়টি বেদনাদায়ক বলে মনে হয় তা হচ্ছে, এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একধরনের নীরবতা। যদিও এ নিয়ে তাদের চেষ্টায় সামান্য অগ্রগতি হয়েছিল, এখন তাদের দ্বিধা বা নিষ্ক্রিয়তার কারণ কী? গত এক দশকে আমরা দেখেছি কী করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ‘স্বাভাবিক’ বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে, কী করে গুমের ঘটনাকে বৈধতা প্রদান করা হয়েছে।

হেফাজতে হত্যার ক্ষেত্রেও এখন প্রায় সেই অবস্থাই তৈরি হয়েছে। কিন্তু এসবের পেছনে কাজ করেছে এই ধারণা যে যাঁরা হেফাজতে মারা যাচ্ছেন, যাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন, যাঁরা গুম হয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা আমার কেউ নন, কিংবা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে আমি একমত নই। কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেবল এক দলের জন্য প্রযোজ্য, অন্যের জন্য নয়-এমন ব্যবস্থা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি।

প্রথম আলোতে প্রকাশিত, ১৪ মার্চ ২০১৮

Leave a Reply