March 29, 2024

নারায়ণগঞ্জ সাত গুম-খুনের পর গত কয়েক দিন বাতাসে যে গুজব ভাসছিল সেটি এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগে। খুনের শিকার হওয়া প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর কালো পোশাকের একটি বিশেষ বাহিনীর দিকে অভিযোগের তীর ছুড়েছেন। কালো পোশাকের বাহিনীটি সৃষ্টির পর থেকে মানবাধিকার লংঘনের অযুত অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। মাঝে-মাঝে তারকা সন্ত্রাসীদের তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার মাধ্যমে বাহিনীটি তার অন্য সকল অপকর্মকে জায়েজ করে। যে কারণে এখানে লিমনের মতো আম-আদমীরা অঙ্গ হারিয়েও কোন বিচার পায় না, বরং  উল্টো রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এ পরিস্থিতি কেন কিভাবে সৃষ্টি হলো? রাষ্ট্রের ভেতরে এরকম আরেকটি রাষ্ট্র কিভাবে তৈরি হলো? এর দায় কার, কতটুকু? গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এর স্থানই বা কোথায়?

আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একটি আধা-সামরিক বাহিনী। কিন্তু এই বাহিনীর আচরণ এবং জনগণের সাথে তাদের মিথষ্ক্রিয়ায় জনমনে এ ধারণা হতে পারে যে এটি সামরিক বাহিনীরই একটি অংশ। একটি আধা-সামরিক বাহিনীর যেভাবে পূর্ণাঙ্গ সামরিকায়ন হয়েছে, যার ফলে এটি এখন দৃশ্যত সামরিক বাহিনীরই একটি বর্ধিতাংশে পরিণত হয়েছে। কেন বা কোন প্রয়োজনে এটি করা হয়েছে সেটি ভিন্ন বিতর্ক ভিন্ন। মোদ্দাকথা হচ্ছে বাহিনীটি পরিচালনায় প্রায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর হাতে। সাম্প্রতিক “বিডিআর বিদ্রোহের” কারণ হিসেবে অন্যান্য অনেক বিষয়ের মাঝে অনেকে এ বিষয়টিকেও দায়ী করেন।

আমাদের দেশে প্রায় দেড় দশক সামরিক শাসন ছিল। তখন সামরিক বাহিনীকে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্দ্রে-রন্দ্রে অনুপ্রবেশ করতে হয়েছে। ফলে দৃশ্যত তাদের নিজস্ব একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বা সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯০-পরবর্তী গণতন্ত্রে আশা করা হয়েছিল যে রাষ্ট্রে বেসামরিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং বেসামরিক প্রশাসন ও নিয়মিত শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে থাকা সামরিক প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। কোন উদীয়মান গণতন্ত্র সুসংহত করার অন্যতম পূর্বশর্তও এটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে সম্ভবত এর উল্টোটি হয়েছে। এখানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে জোরদার হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদল করা রাজনৈতিক দলগুলো স্বীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে নিজেদের সামরিক নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে এবং যার পরিণতিতে বেসামরিক প্রশাসন ও শৃঙ্খলা বাহিনীতে আরো বেশি করে সামরিকীকরণের দিকে ঝুঁকছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনের উপর শ্রদ্ধা ও আস্থাবোধের ঘাটতিও একাজটি করতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে।

এছাড়া ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উদারীকিকরণের ফলে একটি নব্য ব্যবসায়িক শ্রেণিও তৈরি হয়েছে, আপাতঃদৃষ্টিতে যাদের মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য-প্রথার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি প্রবল। এ ধরনের মানুষের হাতে টাকা যাওয়া বিপজ্জনক। এ বিপজ্জনক কাজটি হয়েছে। এই গোষ্ঠী ধরাকে সরা জ্ঞান করে। টাকা দিয়ে সব কিনতে চায়। এমনকি টাকা দিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, নাগরিক সমাজের কণ্ঠ রোধ – এদের অভিধানে সম্ভবত সবই জায়েজ। তাদের অপকর্মের প্রাথমিক সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি দৃশ্যত তারা গুরুত্বপূর্ণ দুটি গোষ্ঠীকেও তাদের অপকর্মের সহযোগী হিসেবে পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটি গোষ্ঠীই রাষ্ট্র ও সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তম্ভ। একটি গোষ্ঠী হচ্ছে গণমাধ্যমের আপোষকামী, দুর্নীতিপরায়ণ একটি অংশ এবং অপরটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীর সুযোগসন্ধানী, দুর্নীতিপরায়ণ অংশ।

র‌্যাব গঠনের শুরুতেই রাষ্ট্রের বেসামরিক শৃঙ্খলা বাহিনীকে সামরিকীকরণের কুফল সম্পর্কে অনেক বিতর্ক হয়েছে। চারদিকে অনেক সমালোচনা ছিল যে এ ধরনের বাহিনী বেসামরিক কোডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। তাদেরকে যেসব শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আত্তীকরণ করা হয়েছে তাদের প্রশিক্ষণ ও মানসিক গঠন ভিন্ন, সিভিলিয়ানদের সাথে আচরণের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। অথবা তারা মূলত সেসব বাহিনী থেকে আসে যেখানে এ বিষয়গুলো মূখ্য নয়। এছাড়া তাদেরকে এমনসব আইনী সুরক্ষা, ছাড় প্রদান করা হয়েছে যা সময়ের পরিক্রমায় হিতে-বিপরীত হতে পারে। এক দশক পর সেসব অনুমান কি সত্য প্রমাণিত হচ্ছে না?

আলোচনা শুরু করেছিলাম রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রশাসন, বিশেষ করে নিয়মিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সামরিকীকরণ নিয়ে এবং গণতন্ত্র সুসংহতকরণে এর অত্যাবশ্যক ভূমিকা নিয়ে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমনিতেই গণতন্ত্রায়নের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাষ্ট্রে সামরিক কর্তৃত্ব বা প্রভাব কমানো। কিন্তু এ আলোচনায় স্পষ্ট যে আমরা আরো বেশি করে সেসবের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের ২০০৯-১৪ এর নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার বেসামরিক প্রশাসনে অভূতপূর্ব সামরিক পদায়ন করেছে (আইজিএস গবেষণা প্রতিবেদন ২০১১)। নিয়মিত শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকেও দিন-দিন আরো বেশি সামরিকায়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা বাহিনীগুলোরও ইতোমধ্যেই সামরিকায়ন সম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রের বড়-বড় ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদেরকে ধীরে ধীরে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। একটি রাষ্ট্র কিভাবে ধীরে ধীরে সামরিকায়ন হয় আগামী এক দশক পর তার বড় কেস স্টাডি হবে বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রের নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রত্যেকেরই স্বীয় অর্পিত দায়িত্ব বা কার্যপরিধি রয়েছে। একজনের দায়িত্ব অন্যজন পালন করতে থাকলে রাষ্ট্র ক্রমশ ভেতর থেকে দুর্বল হতে হতে এক পর্যায়ে অকার্যকর হয়ে পড়বে। আমরা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জরুরি ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। রাষ্ট্রের জনগণের প্রাত্যহিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা নিয়মিত বিভিন্ন শৃঙ্খলা বাহিনীও তৈরি করেছি। একইভাবে আমরা রাষ্ট্রের সীমান্তে অপরাধমূলক কর্মকা- প্রতিরোধে নিয়মিত শৃঙ্খলা-বাহিনীর একটি ইউনিট করেছি। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোকে তৈরি করেছি সংঘটিত অপরাধ তৎপরতা রোধ, অপরাধ ঘটার আগে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করার উদ্দেশ্যে। বহিঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ঝুঁকি থেকে রাষ্ট্রের সার্বিক ঝুঁকি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত গোয়েন্দা বাহিনীও তৈরি করা হয়েছে।

এই সবগুলো বাহিনীর প্রত্যেকের আলাদা-আলাদা দায়িত্ব রয়েছে এবং একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তারা বেসামরিক কর্তৃত্বের অধীনে স্বীয় দায়িত্ব পালন করে যাবে।  মুশকিল হচ্ছে বর্তমানে উপরের সবগুলো দায়িত্বের সাথে সামরিক বাহিনী নিজেদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যুক্ত হয়ে পড়েছে যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতা কাঠামোয় এক বিপজ্জনক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এটি একটি নিয়ন্ত্রণহীন ও কর্তৃত্ববাধী পরিস্থিতি সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে যা জনগণের মনে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির বদলে তাদেরকে আরো বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হচ্ছে একই বাহিনী বা এর সংশ্লিষ্টদের যখন নানা ব্যবসায়িক যে স্বার্থ তৈরি হয়েছে তার সাথে রাষ্ট্রের মূল্যবোধহীন নব্য ধনিকশ্রেণির একাংশেরও অশুভ আঁতাত তৈরি হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেসামরিক আবরণের সামরিক শৃঙ্খলা বাহিনীটির সাথে এসব দুর্বত্ত অংশের ভয়ংকর ও নেতিবাচক সংযোগ সূত্র তৈরি হতে পারে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক ও গোষ্ঠী স্বার্থে বাহিনীটিকে মার্সেনারি ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কী করণীয় সেটি তারা নির্ধারণ করবে। কিন্তু তাদেরকে সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করায় একাডেমিয়ার দায়িত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এটি মাথায় রাখতে হবে যে অতীত ও বর্তমান শাসকদের একের পর এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলেই গোটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি সমান্তরাল রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি বিজ্ঞানে একে “deep state” নামে অভিহিত করা হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রে পর্দার অন্তরালেও একগুচ্ছ রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি সক্রিয় থাকে যারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পাকিস্তান, ইরান ও মিশর এ ধরনের রাষ্ট্রের উদাহরণ যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সামরিকীকরণের ফলে দৃশ্যমান সরকারের চেয়েও অন্তরালের শক্তিশালী ক্রীড়নকের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে সে ধরনের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। এজাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী ছাড়া বাকী সবার মধ্যে এক ধরনের সমন্বিত নিরাপত্তাহীনতাবোধ তৈরি হয় যা থেকে শাসক দলের রাজনীতিকরাও মুক্ত নন। নারায়ণগঞ্জের গুম এর প্রাথমিক উপসর্গ মাত্র। এবং দুঃখজনক হচ্ছে আপাতঃদৃষ্টিতে এ সিস্টেমের সুবিধাভোগীরাও একটা পর্যায়ে এই ব্যবস্থার শিকার হবেন।

যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে বা নেই বলে মুখে ফেনা তোলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এসব অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়ের প্রতি তাদের ন্যূনতম মনোযোগ নেই। যারা ক্ষমতার বাইরে এবং ক্ষমতায় ফেরার জন্য ব্যকুল, এই ব্যবস্থা সংশোধনে তাদেরও কোন বোধোদয় নেই, অঙ্গীকার তো দূরের কথা। কিছু ক্ষেত্রে তারাই এ ধরনের শক্তি তৈরি করেছেন এবং পুনরায় ক্ষমতা পেলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে আরও বিপুল বিক্রমে সেই ডিপ স্টেট-কেই তারা শক্তিশালী করে যাবেন। আর যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন তাদের কাছেও প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করাই এই মুহূর্তে মূখ্য কাজ, সেটি রাষ্ট্রের আরও সামরিকীকরণের বিনিময়ে হলেও। তারা নিজেরাও জানে না তারা কি ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং নিয়মিতই করে যাচ্ছে। এর ফলে তারা কেউই নিরাপদ থাকবেন না।

ক্ষমতা ও নিজ-নিজ গোষ্ঠী-সুবিধা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী অংশসমূহের সত্যিকারের কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নেই বরং তাদের সদিচ্ছার ঘাটতিই প্রবল। ভরসার স্থল নাগরিক সমাজও দ্বিধাবিভক্ত। এই বিষয়গুলোতে করণীয় ও অগ্রাধিকার নির্ধারণে তারাও যথার্থ সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে সবার কণ্ঠস্বর যেন বেশ ক্ষীণ ও ম্রীয়মান। অনেকে ভীত, অনেকে এড়িয়ে চলতে চান। অনেকেই ব্যস্ত টক শোতে সস্তা রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে হাততালি কুড়াতে এবং যেকোনো এক পক্ষকে খুশি করতে।  এহেন পরিস্থিতিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন কেবলই সুদূরপরাহত মনে হচ্ছে।

Leave a Reply